ছেলেবেলা থেকেই মোবাইল কোর্ট শব্দটি শুনে আসছি। গ্রামে অবশ্য লোকে বলতো ‘মবিল কোট’। জিয়া এবং এরশাদের সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে মোবাইল কোর্ট দেখেছি। তখন মোবাইল কোর্ট মানেই ছিল আতঙ্ক। তবে মোবাইল কোর্ট বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পায় ২০০৫ সালে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ দৌলার হাত ধরে। রোকন উদ দৌলা একাই ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে রীতিমত বিপ্লব করে ফেলেন।
রোকন উদ দৌলার নানা অভিযানে হয়তো অনেক বাড়াবাড়ি ছিল। টনকে টন মাছ, আম, দুধসহ নানান পণ্য ধ্বংস করেছেন। ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে ভেজাল খাদ্য বিক্রি করতে দেয়ার চেয়ে ধ্বংস করাই ভালো। ব্যবসায়ীদের লাভের চেয়ে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা মানতেই হবে রোকন উদ দৌলা ব্যবসায়ীদের কিছু ক্ষতি করলেও দেশের মানুষের বিশাল উপকার করেছেন। খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ এখন অনেক কমে এসেছে। রোকন উদ দৌলার অভিযানের সাথে মানুষও অনেক সচেতন হয়েছে। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরাও অনেক সাবধান হয়েছেন।
মাছে বা ফলে ফরমালিন দেয়ার কথা এখন আর তেমন শোনা যায় না। রোকন উদ দৌলার মোবাইল কোর্ট সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির হলেও অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য আতঙ্কের ছিল। এই মোবাইল কোর্টই রোকন উদ দৌলাকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। নিশ্চয়ই রোকন উদ দৌলার আগেও বাংলাদেশে অনেক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কিন্তু তাদের কাউকে বাংলাদেশের কেউ চেনেইনি, মনে রাখা তো অনেক পরের কথা। কিন্তু রোকন উদ দৌলার নাম এখনও বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়।
রোকন উদ দৌলা যে সাহস আর দৃঢ়তা নিয়ে কাজ করেছেন, তা অনুপ্রাণিত করেছে আরো অনেককে। বিভিন্ন সময়ে আমরা মুনীর চৌধুরী, মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারসহ অনেক নাম শুনেছি। এই সাহসের মিছিলে সর্বশেষ নাম ছিলেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। ২০১৫ থেকে ২০২০- এই পাঁচ বছর র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সময় সারোয়ার আলম দুর্নীতি-অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। একের পর এক অভিযানে তিনি তছনছ করে দেন সব অনিয়মের আখড়া। পাঁচ বছরে তিনি তিনশরও বেশি সাহসী অভিযান পরিচালনা করেছেন। পাবলিক পারসেপশনে সবগুলো অভিযানই বিপুল জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
স্মৃতি হাতড়ালে আপনিও মানবেন, সারোয়ার আলম যা করেছেন, ভালো করেছেন। ক্যাসিনো, সম্রাট, জিকে শামিম, রিজেন্ট হাসপাতাল, ভুয়া করোনা টেস্ট, ডেঙ্গু টেস্ট, নকল পণ্য, নকল কসমেটিকস, ভেজাল খাদ্য, নামীদামী সব হাসপাতালে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে রীতিমত ‘জনগণের নায়ক’ বনে যান সারোয়ার আলম।
রোকন উদ দৌলা থেকে সারোয়ার আলম- তাদের অভিযান দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যেতাম। এত সাহস তারা পায় কোত্থেকে! বুঝতে পারি, নিশ্চয়ই সরকারের সবুজ সঙ্কেত নিয়েই তারা অভিযানে বেরুচ্ছেন। নিজের আগ্রহে হলে একদিন করা যায়। কিন্তু নিয়মিত অভিযানের জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত লাগে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে হলেও সারোয়ার আলম যেমন অনমনীয় দৃঢ়তা নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতেন, ব্যক্তিগত চারিত্রিক দৃঢ়তা না থাকলে সেটা সম্ভব নয়।
সারোয়ার আলম যা করেছেন, পাবলিক পারসেপশনে তার সবটাই ঠিক। কিন্তু আইনের কথা বললে, সেখানে অনেক ব্যত্যয় ঘটেছে। আইনের শাসন আছে, এমন কোনো রাষ্ট্রে মোবাইল কোর্ট আসলে চলতে পারে না। তবে বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থাহীনতার কারণেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে মোবাইল কোর্ট। ক্রসফায়ারের জনপ্রিয়তা আর মোবাইল কোর্টের জনপ্রিয়তা মোটামুটি কাছাকাছি ধরনের।
আসলে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে অতিষ্ঠ মানুষ ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ স্টাইলের বিচারে আস্থা রাখে। ক্রসফায়ার পুরোপুরি বিচারবহির্ভূত হলেও মোবাইল কোর্টে কিছুটা বিচারিক আবরণ থাকে। তবে এটা হলফ করেই বলা যায়, বেশিরভাগ মোবাইল কোর্টের তাৎক্ষণিক রায়ে অভিযুক্তেরা ন্যায়বিচার পান না। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ তারা পান না। জনপ্রিয়তা আর তাৎক্ষণিকতার স্রোতে অনেক নির্দোষ মানুষও সাজা পেয়ে যায়, যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
তাছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এমন ঢালাও অভিযান নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করার ধারণার সাথেও সাংঘর্ষিক। আমি নিশ্চিত সারোয়ার আলমের অনেক অভিযানেও বাড়াবাড়ি হয়েছে। ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় ঘটেছে। হাইকোর্টে গিয়েও তাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে।
কিন্তু ম্যাজিস্ট্রটেদের এই সাহসী অভিযানের পরিণাম সবসময় তাদের জন্য ভালো হয়নি। আড়ংএ অভিযান চালানোর ‘অপরাধে’ রাতারাতি বদলি করা হয়েছিল ভোক্তা অধিকারের মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারকে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তার বদলি ঠেকানো গিয়েছিল। কিন্তু এরপর আর মঞ্জুর সাহস দেখাতে মাঠে নামেননি। হাজী সেলিমের বাসায় অভিযানের পর বদলি হতে হয়েছিল সারোয়ার আলমকেও। ব্যাপারটি এমন নয় যে সারোয়ারের বদলির পর বাংলাদেশের সবাই ভালো হয়ে গেছে বা অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আগের মত মোবাইল কোর্ট কিন্তু আমরা আর দেখি না।
সারোয়ার আলমের বদলি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও। তিনি বলেছিলেন, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কারণ সরকারি কর্মচারিরা চিরদিন এক পদে কাজ করেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় যুক্তি ছিল। কিন্তু যখন উপসচিব পদে প্রায় ঢালাও পদোন্নতির তালিকায়ও নাম থাকে না সারোয়ার আলমের, তখন প্রশ্নটা আরো বড় করে ওঠে- তাহলে কি সারোয়ার আলম অনিয়সের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ভুল করেছিলেন?
গত ৭ মার্চ ৩৫৮ জন কর্মকর্তাকে উপসসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে সারোয়ার আলমের ব্যাচের মানে ২৭তম ব্যাচের আছেন ২৪০ জন। কিন্তু সারোয়ার আলম পাননি। তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় অভিযোগ নেই। বরং ঝুড়িভর্তি সাফল্য। কিন্তু সকল যোগ্যতা থাকার পরও তিনি পদোন্নতি পাননি। ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষে থাকে। কিন্তু প্রমাণিত হলো সাহসীরা প্রমোশন পান না।
সারোয়ার আলম কাজের ক্ষেত্রে যদি কোনো ভুল করে থাকেন, তাহলে যারা তাকে অভিযানের অনুমতি দিয়েছিল তাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে, জবাব দিতে হবে। তিনি যদি কোনো বাড়াবাড়ি করে থাকেন বা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতো। কিন্তু সেসব কিছু না করে তাকে বদলি করে এবং পদোন্নতি বঞ্চিত করে একটা বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করা হলো। এরপর কি আর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট এমন সাহস নিয়ে অভিযানে যাবেন?
এ ব্যাপারে সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর অনেকেই আমাকে ফোন দিয়ে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। আমার পদোন্নতি হয়নি বলে অনেক সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি পদোন্নতি পাওয়া অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না বলে আমাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তারা অবাক হয়েছেন। তবে এটাই বাস্তবতা।‘ তিনি বলেছেন, ‘আমি সবসময় জনগণের জন্য কাজ করেছি। যেসব জায়গায় জনগণ প্রতারিত হচ্ছিল, সেগুলো ধরে ধরে কাজ করে মানুষের মনে স্থান করতে পেরেছি। সততা, কর্মদক্ষতা কোনোদিক দিয়েই পিছিয়ে ছিলাম না। আমার প্রমোশন হয়নি, এটা কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবে হতাশাটা গোপন করতে পারেননি সারোয়ার আলম। ফেসবুকে লিখেছেন, ‘চাকরিজীবনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়েছেন তাদের বেশিরভাগই চাকরিজীবনে পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই অন্যায়!’
এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই অন্যায়- সারোয়ার আলমের এই আক্ষেপের জবাব কি কারো কাছে আছে?
লেখক: প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ