মো. এনামুল হক লিটন, চট্রগ্রাম:
চট্টগ্রামের সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্পের অভিযাত্রায় অন্যতম অগ্রপ্রতিক, সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও আধুনিক মুদ্রণশিল্প ও প্রকাশনা জগতের পথিকৃৎ, চট্টগ্রামের প্রথম ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও প্রাচীনতম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক চট্টগ্রামের ক্ষণজন্মা পুরুষ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুল খালেক সাহেব একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুল খালেক উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলিয়ে কেরাম হযরতুল আল্লামা ছৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটির (র.)-এর প্রধান খলিফা হিসেবে ধর্মিয় ক্ষেত্রেও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, শিক্ষা-সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় পৃষ্ঠপোষকতা এবং এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেস। যা ছিল এ অঞ্চলের প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ছাপাখানা।
এর পূর্বে ১৯২৯ সালে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুল খালেক চট্টগ্রাম শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোহিনুর লাইব্রেরী। ১৯৫০ সালের ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক কোহিনুর পত্রিকা। তিঁনি ছিলেন, এর সম্পাদক ও প্রকাশক। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের জনপ্রিয় দৈনিক আজাদী প্রকাশ করেন। ওই সময়ে কোহিনুর প্রেসও পত্রিকাকে ঘিরে চট্টগ্রামের বুকে গড়ে ওঠে একটি সৃজনশীল সাহিত্য ও সাংবাদিক গোষ্ঠি। তিনি সিলসিলাহ ও আলীয়া কাদেরীয়ার একজন খলিফা ছিলেন। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সাথেও জড়িত ছিলেন এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুল খালেক চট্টগ্রাম জেলার রাউজান সুলতান গ্রামে ১৮৯৮ সালের ২০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন।
শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন তিঁনি। ১৯২০ সালে চট্টগ্রামে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এসময় আকর্ষণীয় বেতনের অনেক চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে নিজ জন্মস্থানে ফিরে এসেছেন এই সেবাব্রতী মণীষী। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ।
পেশাগত জীবনে চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ণের পাশাপাশি এ অঞ্চলটিকে মননশীল ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনুর লাইব্রেরী। ১৯২৯ সালে এই লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। পরের বছর প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস, যা চট্টগ্রামে ছাপাখানা জগতে বিপ্ল¬বের সূচণা করে এবং এটি ছিল এ অঞ্চলের প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ছাপাখানা।
সে সময় মননশীল বিভিন্ন সাহিত্য সংকলনসহ বেশকিছু পত্রিকা এই প্রেস থেকেই ছাপা হতো। তৎকালিন দেশের এক বৈরী সময়ে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক শোষকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই প্রেস থেকেই ছাপিয়েছিলেন মাহবুবুল আলম চৌধুরীর রচিত ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাথা কালজয়ী সেই অবিস্মরণীয় কবিতা “কাঁদতে আসিনি আমি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি”।
এই কবিতাটি প্রকাশনার দায়ে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তৎকালিন পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে নানাভাবে ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছিল কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসের মালিক-কর্মচারীদেরও। এত সবকিছু উপেক্ষা করে অবশেষে এই প্রেস থেকেই ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী।
এই পত্রিকা প্রকাশে তিনি যে পরম নিষ্ঠা ও অক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন তা সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়নতার পরিচয় তুলে ধরে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী এই মহামণীষী মানুষকে দেখেছেন, সবকিছুর উর্ধ্বে। একটি নিরপেক্ষ সংবাদপত্র প্রকাশের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে আধুনিক বিশে^র সাথে যুক্ত করার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে দৈনিক আজাদী পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠার মাত্র আড়াই বছরের মাথায় ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
এই যুগ সচেতন মনীষী তাঁর সম-সাময়িক কালে খানিকটা পিছিয়ে থাকা মুসলমান সমাজে তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই অগ্রগামী। চট্টগ্রামকে আলোকিত করার জন্য বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। একজন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারের নিশ্চিত জীবন তিনি গ্রহণ না করে পা বাড়িয়েছিলেন অনিশ্চিতের দিকে।
তীক্ষè, দুরদর্শী ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব আপন আরাম-আয়েশ-বিলাস বৈভবের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণবোধ না করে সুদূরপ্রসারী অথচ ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষ্য নিয়ে প্রকাশনা জগতের প্রতিকূলতাসংকুল পথে যাত্রা শুরু করে আলোকিত মানুষ গড়ার চেষ্টায় পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তৎকালীন পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পত্রিকা প্রকাশনা যে কত কঠিন ব্যাপার ছিল তা বর্তমান সময়ে অনুধাবন করা কঠিন। মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সেই কঠিন কাজটিই বেছেঁ নিয়েছিলেন। তিনি কেবল পত্রিকা প্রকাশ, লাইব্রেরী বা ছাপাখানা করে থেমে থাকেন নি।
কবি, সাহিত্যিকদের প্রতিও তার ছিল অগাদ ভালবাসা। তার প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়ে ওইসময়কালে অনেকে সাংবাদিক-কবি, সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক আজাদী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার ও ঔপনিবেশিক দখলকারীমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উজ্জ্বল সূর্যালোকের স্পর্শধন্য মাটিতে প্রথম প্রকাশিত দৈনিক হিসেবে আর্বিভাবের গৌরবের অধিকারী।
একদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনকালে প্রথম সফল প্রতিরোধ রচনা এবং অন্যদিকে এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত মুক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামের সফলতা প্রথম মুহুর্তে রক্তাক্ষরিক সুসংবাদ বহন করে, জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার অভিন্ন গৌরবের অধিকারী যে অভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সে প্রতিষ্ঠানের স্থপতি হিসেবে মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক ভাস্বর মিনার।
ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সৎ ও ধর্মপ্রাণ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে কোন প্রকার সংকীর্ণতা ও একদেশদর্শীতা কোনদিন স্পর্শ করতে পারে নি। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মধ্যে ধর্ম ও প্রগতির সুষম সমন্বয় তাঁকে এক অনবদ্য আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যে পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধ ও মানবতাবোধে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের সকল প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাং®কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম কাতারের সহযোগী ও যোগানদারের সফল ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন, ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকীর এইদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও রুহের মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সেই পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধ ও মানবতাবোধ আমাদের প্রজন্মতরে সঞ্চারিত হোক। এটাই একান্ত কামনা। আল্লাহ তাঁর বেহেস্ত দান করুন। আমিন।
-লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, প্রগতিশীল সংবাদপত্র পাঠক লেখক ফোরাম, কেন্দ্রিয় কমিটি।