চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার দক্ষিণ সাধনপুরের কুমারপাড়ার প্রবেশ মুখেই ৭৫ বছর বয়সী গৈারাঙ্গ রুদ্রের ঘর। চাক ঘুড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে তৈরি করছিলেন মাটির পাতিল। অভাবের সংসারে তের বছর বয়সে বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে ষাট বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি। এ পেশায় ঠিকমত সংসার চলে না। খেয়ে না খেয়েই কাটে গৈারাঙ্গদের জীবন। লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলে সন্তানদের যোগ্য করতে না পারার কষ্ট তার আমৃত্যু। ভিন্ন পেশায় যাওয়ার পুঁজি ছিল না বলে পরিবর্তন করতে পারেনি পেশা। একসময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যবহার ছিল মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলের। হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, মটকা, শানকি, থালা ও বাসনসহ বিভিন্ন মাটির সামগ্রী তৈরি করে চলতো মৃৎশিল্পী বা কুমারদের সংসার। বর্তমানে এই স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন প্লাস্টিক, স্টিল, মোলামাইন ও সিলভার সামগ্রী। মাটির সামগ্রীর আগের মতো চাহিদা না থাকায় সংকটের মুখে কুমোরপাড়ার শতাধিক পরিবার। মাটি, আগুন ও খড়ের সঙ্গে যাদের সাত পুরুষের জীবনপণ যুদ্ধ।
কুমারপাড়ার আরেকটু ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা হয় বিমল রুদ্রের সঙ্গে। উঠোনে শুকাতে দেওয়া মাটির হাঁড়িগুলো নিয়ে খড়কাঠি দিয়ে চুলো জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। উঠোনের কোণে বিশাল এটেল মাটির স্তুপ। জানতে চাইলে তিনি অনেকটা আক্ষেপ করে বলেন, বছর সাতেক আগেও এক পিকাপ মাটি সংগ্রহ করতে চার পাঁচশ টাকা লাগতো। এই কয়েক বছরে মাটির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এক গণ্ডা জমির মাটি কিনতে হচ্ছে চার-পাঁচ হাজার টাকায়। সেই জমির ৮ ফুট নিচ থেকে এটেল মাঠি তুলে আনতে প্রতি পিকাপ গাড়িতে খরচ হচ্ছে হাজার দেড়েক টাকা। কাঠ আর খড়ের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। এতকিছুর পরও দাম বাড়েনি মাটির তৈরি সামগ্রীর। একটি মাটির ছোট হাঁড়ি তৈরিতে উৎপাদন ব্যয় ১২ টাকা হলেও পাইকাররা কিনে নেয় ১৫ টাকায়। নগরের টেরিবাজার, গোসাঁইলডাঙ্গা, বকসিরহাটসহ বিভিন্ন উপজেলার হাটবাজার থেকে আসেন পাইকাররা ।
এসময় মৃদুল রুদ্র নামের অপর এক কুমোর জানান, বাঁশখালীর উত্তর ও দক্ষিণ সাধনপুর মিলিয়ে শতাধিক পরিবার কুমোরদের। উত্তর সাধনপুরের ৪০টি পরিবারের মধ্যে দু-চারটি ছাড়া সকলেই এ কাজ ছেড়ে দিয়েছে। পরিবর্তন করেছে তাদের পেশা। দক্ষিণ সাধনপুরের এই পাড়ায় ৬০টির মত পরিবার আছে তার মধ্যে ২০টি পরিবার এ পেশা ছেড়েছে। তার অনেকগুলো কারণও আছে যেমন আগের মত মাটির জিনিসের চাহিদা নেই। যার কারণে আয় কমে গেছে আমাদের। বর্ষা এলেই বেকার হয়ে পড়ি আমরা। দাঁদনদারদের কাছে জিম্মি হয়ে যাই। তাদের কাছ থেকে মৌসুমে উৎপাদন মূল্যে পণ্য বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিই। যার কারণে মৌসুমে পরিশ্রমের সুফল পাই না আমারা। ইদানিং নতুন করে চাহিদার কিছু ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। যেমন নার্সারি ও ছাদবাগান করতে প্রচুর টবের অর্ডার আসছে। কিন্তু আমাদের তো পুঁজি নেই কাঁচামাল কেনার। সরকারি কোনো ব্যাংক আমাদের ঋণ দেয় না। কারণ আমরা তো ব্যবসায়ী না। নেই কোন প্রণোদনা। সরকার ১০ টাকায় কৃষকদের একাউন্ট খুলে লোন দিচ্ছে। আমাদের কি দিচ্ছে? আমরা প্রকৃতির সন্তান অথচ আমাদের জন্য সরকারের হাত প্রশস্ত হচ্ছে না। কোথায় যাবো, পৈত্রিক ভিটাতে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি। আধুনিকতার প্রভাবে ছেলেমেয়েরা এ পেশা ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছে।
মোহন রুদ্রের স্ত্রী আরতি বালা আফসোস করে বলেন, অতীতে এই পেশায় ভালই লাভ হতো। বিয়ের আগে দেখেছি প্রতি বছর নবান্ন উৎসবের পর থেকে তিন-চার মাস চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে গ্রামে বড় বড় মেলা বসত। তখন আমার বাবা ভাইয়েরা গাড়ি ও নৌকা করে মাটির সামগ্রী নিয়ে যেত বিক্রি করতে। সরাসরি বিক্রি করত বলে লাভও হত। এখন মেলাও নেই, বিক্রিও নেই। পাইকারদের কাছে বিক্রি করে কত আর পাওয়া যায়! আবার কবে সুদিন আসবে কুমোরপাড়ায় জানি না। কবে কুমোর পাড়ার ভাঙ্গা ঘরগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে! নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এ পেশা। সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সংগঠক আবদুস সোবহান বলেন, পরিবেশ বাঁচাতে মৃৎশিল্পী বা কুমারদের ফেরাতে হবে পেশায়। নগর জীবনেও মাটির সামগ্রীর ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি অর্থায়ন বা ঋন দিয়ে তাদের সহায়তা করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাতে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমাতে হবে। কারণ পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য হলে সহজে নষ্ট হয়না। শত শত বছর ধরে মাটির নিচে এগুলো থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে কর্তফুলী নদীর কথা বলা যায়, গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দর এই নদী ড্রেজিং করতে পারছে না। কারণ নদীর তলদেশে ১০ ফুটের মতো পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য জমে আছে। যেখানে আটকে যাচ্ছে ড্রেজার মেশিনের কাঁটা। নাগাল পাচ্ছে না মাটির। যার কারণে নদীর তলদেশে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে।
