অগ্রতির নানা মানদন্ডে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক দ্যা ইকোনমিস্ট-২০২৩ (১৫ ডিসেম্বর) একটি জরিপ রিপোর্ট করে। ছোট ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। মাথাপিছুআয়ের সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে দেখা যায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৭৬৫ ডলার, ভারতে ২৬১২ ডলার এবং পাকিস্তানের তা হলো ১৪৭১ ডলার। যা বাংলাদেশের আয় পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২০ ডলার, পাকিস্তানের ১৮০ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু ছিল ১৩১৬ ডলার অন্যদিকে পাকিস্তানের ছিল ১৪৭০ ডলার। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত গতিতে মাথাপিছুআয় বৃিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র ৩-৪ শতাংশ।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে যখন বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশটির জন্ম হয় তখন তার জিডিপির ৬-৭ শতাংশ আসত শিল্পখাত থেকে। তখন পাকিস্তানের শিল্পের অবদান ছিল ২০%বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্প খাতের অবদান জিডিপি’র ২৯ শতাংশ। এই হার দিন দিন বাড়ছে। তৈরী পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের সাফল্য আসলেই নজর কাড়া। ভারত ও পাকিস্তান মিলে যে পরিমান গামেন্টস রপ্তানি করে বাংলাদেশ একাই তার চেয়ে বেশি রপ্তানি করে।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে তৈরী পোশাক রপ্তানির পরিমানে চীনকে টপকে শীর্ষে পৌছেছে বাংলাদেশ। ইইউর বাজারে ২০২২ সালে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১৩৩ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে চীনের রপ্তানি ছিল ১৩১ কোটি কেজি। এ তথ্য জানায় ডিজিএমইএ।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বেশি হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে দ্রুত হারে কমে যাওয়া জনসংখ্যা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ১.২% যেখানে ভারত হচ্ছে ১.৪১% এবং পাকিস্তানে ২.৫৫%।
আমরা যখন যুদ্ধ করে পাকিস্তানকে হারিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করি তখন আমাদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটির মত। আর আয়তনে আমাদের চেয়ে ৫ গুন বড় পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাত কোটি। আজকে আমাদের জনসংখ্যা ১৬.৫ কোটি যেখানে পাকিস্তানের তা ২৪ কোটি। শ্রম শক্তিতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতি ৩ জনের একজন নারী কাজ করে। এ সংখ্যা ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি ৫ জনের ১ জন কর্মক্ষম নারী। অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের ৩৫% নারী যা ভারতের ২৩% এবং পাকিস্তানের ২০%। নারী কর্মসংস্থানে ভারত পাকিস্তান থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ।
আর্থসামাজিক প্রায় সব সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে ভারত ও পাকিস্তান থেকে। মানব উন্নয়নের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে এসেছে। বর্তমানে আমাদের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর। ভারতে এ সংখ্যা ৭২ বছর এবং পাকিস্তানে মাত্র ৬৯ বছর। শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে হাজারে ৩০, ভারতে ৪০ এবং পাকিস্তানে এর সংখ্যা ৭০ এর বেশি। প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের সাফল্য প্রায় শতভাগ। আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার হার ৪২%। পাকি¯াÍ নে এই হার অর্ধেক এর ও কম ১৫% এবং ভারত এই ক্ষেত্রে ২৭ শতাংশ।
আমাদের ছেলে-মেয়েরা গড়ে ১২.৪ বছর ধরে লেখাপড়া করে। যেখানে পাকিস্তানের হার ৮.১ বছর। মানব উন্নয়ণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে ১২৯ তম। ভারত ১৩২ এবং পাকিস্তান ১৬১ তম।
মোবাইল ব্যাংকিং-এ বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ লেনদেনকারী দেশ। এখন ভারত, চীন সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে রোল মডেল মনে করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। মোবাইল ব্যাংকিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। যা শহর থেকে গ্রামে যায়। যার ফলে গ্রামীণ অর্থ ব্যবস্থা সচল হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ এগিয়ে রংপুর বিভাগের লোকজন।
অর্থনীতির বাহিরে ও বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পরার মত। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবদানে কথা সারা বিশ্বেরই জানা। যেখানেই বাংলাদেশের সৈনিক ও পুলিশ শান্তি মিশনে গিয়েছেন সেখানেই সুনাম কুিড়য়ে এনেছেন। আফ্রিকার একটি দেশ সিহরালিওন বাংলা ভাষা কে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছে। আমাদের দেশে লাখ লাখ অনাবাসী ও উদ্যোক্তা ভাই-বোনেরা পৃথিবী জুড়ে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি দেশেই তাদের কর্ম দক্ষতা সদাচরন ও শান্তিপ্রিয়তার সু-খ্যাতি শুনেই মনটা ভরে যায়।
১৯৭১ সালের আগে যে অঞ্চলটি আজকের বাংলাদেশ সে অঞ্চলে শিল্প ও আর্থিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান খুব সামান্যই গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য ও শিল্পে তাই বাঙালির হিস্যা ছিল খুবই সামান্য। এরকম একটি পরিপ্রেক্ষিতে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তখন ্আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ও বড় পরাশক্তির ধারণা হয়ে ছিল যে, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতেই পাড়বে না। হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীণ একটি কমিটি মনে করেছিল এটি হবে ‘আন্তর্জাতিক এক তলাবিহীন ঝুড়ি’। এখানে যতই সাহায্য ঢালা হোক না কেন তা কোন কাজেই লাগবে না। তাই দেশটিতে দ্রুতই দূর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দিবে।
ঐসময়ে সিআইএ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এত অল্প জায়গায় এত মানুষের বাস এবং এত দারিদ্রের কারণে দেশটি তার প্রতিবেশী ও বিশ্বের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। অথচ সে দেশটি আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ১৯৭২ বলা হয়, পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলে মাথাপিছু আয় ছিল ৫০-৬০ ডলারের মত এবং তা ছিল প্রায় স্থবির। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরেরও কম, বেকারত্বের হার ছিল ২০-৩০ শতাংশ। শিক্ষার হার ২০ শতাংশ। প্রকৃতি ছিল ভয়ংকর প্রতিকূল। তৎসময়ের বিশ্ব ব্যাংকের দুই সিনিয়র অর্থনীতিবিদ মনে করে ছিল বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙ্গন সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে এ দেশের উন্নয়নে কোন সম্ভাবনাই তাদের মনে উদয় হয়নি।
কি আশ্চর্য! সে হতভাগ্য দেশটিই কিনা আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারাবিশ্বের নজর কেড়েছে। এখানে শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়েছে এবং একসাথে ১০০টি সেতু উদ্বোধন করা হয় এবং ৫৬৪টি মডেল মসজিদ করা হয়েছে সরকারীভাবে। যা পৃথিবীতে এ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্র করার সাহস দেখায়নি। শুধু মাথাপিছু আয় কেন অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের প্রায় সবকটি সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।
ম্যালথাস তত্ত্বে বিশ্ববাসীদের অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ১.২ শতাংশে। বাংলাদেশের প্রতি দম্পত্তির সন্তান সংখ্যা দুইজন। পাকিস্তানে তা প্রায় সাত জনে। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ শিশু প্রাথমিক স্কুলে যায়। পাকিস্তানের এ হার ৭০ শতাংশের মতো এবং পাকি¯াÍ নের সার্বিক শিক্ষার হার তো মাত্র ২০ শতাংশ। কি করে ঘটল বাংলাদেশের আর্থ ও সামাজিক এই বিপ্লব! এর মূলে রয়েছে এদেশের লড়াকু মানুষ। একাত্তরে হার না মানা মানুষের অপরাজেয় প্রাণশক্তির নানামাত্রিক বিকাশের ফসল আমাদের এই সাফল্য। বঙ্গবন্ধু অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশটির ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো পূণঃনির্মাণ করে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার শক্ত পাটাতন তৈরী করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুতনয়ার সাহসী বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপের কারণে আজ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি করেছে। আজ বাংলাদেশ মাথা উঁচু করার এ পর্যায়ে এগিয়ে আনতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূঢ় প্রসারী কল্যানী অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশলের কথা না বললেই নয়। অসাধারণ আন্তরিকতার সাথে তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রয়োজনীয় নীতিকৌশল গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়ণে নিরন্তর মনিটরিং করেন। আমরা ২০৩০ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশ হতে চাই।
লেখক : হাসান সরকার
সাংগঠনিক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদ, সেন্ট্রাল ল’ কলেজ, ঢাকা ও
সভাপতি, নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগ, সদরপুর, ফরিদপুর।