রাষ্ট্রায়ত্ব জ্বালানি তেল বিতরণ কোম্পানি যমুনার কেয়ারটেকার লতিফ ওরফে স্বর্ন লতিফ এখন প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বিত্ত বৈভবের মালিক।
এক সময়ের সবজি বিক্রেতা আব্দুল লতিফ ওরফে স্বর্ন লতিফ প্রায় ত্রিশ বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ব জ্বালানি তেল বিতরণ কোম্পানি যমুনার কেয়ারটেকার পদে চাকরি নিয়ে মিরপুর-২ নম্বরের কমার্স কলেজ রোডস্থ যমুনা অয়েল কোম্পানি লিঃ এর মিরপুর অফিসের দেখাশোনার দায়িত্ব পান। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই নিজস্ব পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন সরকার মালিকানাধীন এই অফিস ও এর সংলগ্ন খালি জায়গাটি।নিজস্ব লোকজন ও বহিরাগত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গড়ে তোলেন মাদক ব্যবসা, রিকশা গ্যারেজ, দেশি-বিদেশি ছাগলের খামার।একই সাথে জড়িয়ে পড়েন, জুয়ার আসর পরিচালনায় ও সুদি কারবারে । তার এসব অবৈধ কাজ পরিচালনার জন্য নিজের বেতন ১৫ হাজার টাকা হলেও তার ম্যানেজারের বেতন প্রায় ৬০ হাজার টাকা। নিজেও হয়েছেন শত ভরি স্বর্ণ ও পাঁচটি বিলাস বহুল ফ্ল্যাটসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আব্দুল লতিফ প্রায় ত্রিশ বছর আগে সবজি বিক্রেতা থেকে হঠাৎ করে রাষ্ট্রীয়ত্ব জ্বালানি তেল বিতরণ কোম্পানি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিঃ এর কেয়ারটেকার / প্রহরী পদে চাকরি পান।চাকরি জীবনের শুরু থেকেই তিনি রাজধানীর মিরপুরের কমার্স কলেজ রোডস্থ যমুনা ওয়েল কোম্পানি লিঃ এর অফিস ও সংলগ্ন জায়গা দেখা-শোনার দায়িত্ব পান। সেই থেকেই বদলে যেতে থাকে আব্দুল লতিফ এর জীবনযাত্রা। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ভোগ করতে থাকেন সরকারি মালিকানাধীন জায়গাগুলো। প্রথমে মাছ চাষ, গরু-ছাগলের খামার এবং রিকশার গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করে ভাড়া দিয়ে রাতা-রাতি বিপুল পরিমাণ টাকা কামানো শুরু করেন। এলাকাবাসীর মতে, টাকার নেশায় মত্ত হয়ে তিনি জায়গাটি নানা বয়সী লোকদের আড্ডা খানায় রূপান্তর করেন এবং স্থানীয় উঠতি বয়সী ছেলেদের দিয়ে বিভিন্ন রকমের মাদক বিক্রি করা শুরু করেন। সেই থেকেই লতিফের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এক সময় অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটানো লতিফ হয়ে ওঠেন সমাজের মাথা। জীবন ধারায় আসে নাটকীয় পরিবর্তন।ব্যবহার করতে থাকেন নিত্য নতুন মডেলের মোটরবাইক। হয়ে ওঠেন একের পর এক ফ্লাট বাড়ির মালিক এবং একাধিক লাইসেন্স নেন মদ পানেরও । জুয়েলারি কোম্পানির মডেলদের হার মানিয়ে লতিফ চেইন ব্রেসলেট আংটি সহ নানা স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন এলাকায়। তখন থেকেই কেয়ারটেকার লতিফের নাম হয়ে যায় লতিফ ওরফে স্বর্ণ লতিফ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,টাকার নেশায় মাতাল হয়ে লতিফ মিরপুর-২ নম্বর ডুইপ এলাকার শাহিন সাহেবের ৭নং রোডের ১ নং টিনশেড বাড়িটি ভাড়া নিয়ে বিগত সরকারের স্থানীয় নেতাকর্মী ও এক কাউন্সিলরের সহযোগিতায় জুয়ার আসর পরিচালনা করেন। স্থানীয়রা জানান, লতিফ তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের দিয়ে কমার্স কলেজ রোড ও মসজিদ মার্কেট রোডে দুই পাশে পাহারা বসিয়ে অবৈধ জুয়ার আসর নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতেন। জুয়ার বোর্ড থেকে লাখ লাখ টাকা কমিশন নিতেন এবং জুয়াড়িদের টাকার প্রয়োজন হলে হাজারে দুইশত টাকা করে কমিশন নিয়ে তাদের টাকা সরবরাহ করতেন। এছাড়াও, জুয়াড়িদের কাছ থেকে চেইন,আংটি ও মোবাইল বন্ধক ও ক্রয় করতেন।
বর্তমানে, জুয়াড়িদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হওয়ায় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে জুয়ার আসর আপাতত বন্ধ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিঃ এর ভিতরে অবৈধভাবে ত্রিশটিরও অধিক রিকশা গ্যারেজ, বেশ কয়েকটি অটোরিকশার চার্জিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। হরিয়ানা, তোঁতা, রাম ও দেশি প্রজাতির ছাগলের খামার রয়েছে। বর্তমানে লতিফের রয়েছে মিরপুর-২ নম্বর ডুইপ এলাকার এ ব্লকের ৭ নম্বর রোডে ৭ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায়(সম্পুর্ন) একটি ফ্ল্যাট,বি ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ির তৃতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় তিনটি ফ্ল্যাট। এলাকাবাসীর মতে, গাড়ি,বন্ধকে খাটানো,সুদে লাগানো সহ লতিফের রয়েছে বিপুল অংকের নগদ কালো টাকা। তারা লতিফের অবৈধ মাদক ব্যবসা এবং জুয়ার আসর বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে স্বর্ণ লতিফ ঢাকা প্রতিদিনকে জানান, আমার স্ত্রী দুই জন,আমি ছোট থেকে সবজি বিক্রি করতাম। আমি চাকরির পাশাপাশি বিল্ডিং ভাঙ্গার ঠিকাদারি কাজ করি,আমি বহু বছর থেকে এখানে আছি তাই এখানে ছাগল-গরু পালন করি, রিকশা গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে থাকি। আগে জুয়ার বোর্ড চালালেও এখন বন্ধ রাখছি। এছাড়া, আমি মাদক সেবন করলেও মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত না।আমার পাচঁটি নয় চারটি ফ্ল্যাট আছে। স্থানীয় কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে পেট্রেবাংলার অধীনস্থ রাষ্ট্রায়ত্ব জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিঃ এর ডি জি এম আনোয়ারুল ইসলাম ঢাকা প্রতিদিনকে জানান, লতিফের এ জাতীয় অবৈধ কর্মকান্ডের সাথে আমার অফিসের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমি ইতোপূর্বে তার বিরুদ্ধে এজাতীয় অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। গত এপ্রিলে অভিযান চালিয়ে আমার মিরপুর অফিস দখল করা তার রিকশা, গরু-ছাগল সব কিছু বের করে দিয়েছি। সে যেহেতু নির্দেশনা অমান্য করে আবারো এ জাতীয় অনিয়মের সাথে যুক্ত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার স্থলে নিরাপত্তাকর্মী আরও বৃদ্ধি করে সরকারি স্থাপনা ও সম্পত্তির পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।
এছাড়া মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাকসুদ জানান, বিষয়টি আমার নজরে এসেছে, আমি খোঁজখবর নিচ্ছি। আমার এলাকায় এ ধরনের কোনরকম অবৈধ কার্যক্রম চলবে না এবং কেউ যদি এজাতীয় অবৈধ কিছুর ভুলেও পরিকল্পনা করে থাকে, তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একসময়ে কেন্দ্রীয় এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার ডান হাত খ্যাত এবং স্বৈরশাসকের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী স্বর্ণ লতিফ, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের বোল পাল্টে, বর্তমানে স্থানীয় থানা বিএনপি’র এক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় এলাকায় গ্যারেজ দখল, ফুটপাত দখল, বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি এবং বন্ধ হওয়া জুয়ার আসর চালানোর পায়তারা করছেন ।