আব্দুল বাশির, গোমস্তাপুর থেকে
অনাবিল সৌন্দর্য আর শুভ্রতায় মোড়ানো চিরসবুজ গ্রাম যে এখনও রয়েছে তা পাথরপূজা গ্রামটি দেখলে বিশ্বাস হবে। যান্ত্রিকতা, কৃত্রিমতা ও বিষাক্ত বাতাস এখনো স্পর্শ করতে পারেনি গ্রামটিকে। পাথরপূজা গ্রামটি তার নামের মতই সুন্দর। অপরূপ নিপুন শৈলী আর যত্ন নিয়ে বানানো মাটির বাড়িগুলো যেন শিল্প আর সৌন্দর্যের আধার। নয়ন জুড়ানো বাড়িগুলো দেখলে যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। রাস্তার চারপাশে কৃষি জমি আর সবুজ ঘাস যেন একেকটা রং তুলিতে আঁকা বিখ্যাত ছবির ক্যানভাস। মুগ্ধতার পল্লী এই পাথরপূজা গ্রামের প্রতি ইঞ্চি জমিতে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস। ইতিহাস গুলো যেন অপেক্ষা করছে তাদের ঐতিহাসিক প্রকাশে। পুরো পাথরপূজা গ্রামটির মাটির নিচে রয়েছে প্রাচীন বিশাল আকৃতির পাথর। একটি দুইটি নয়, শত-শত, হাজার-হাজার পাথর রয়েছে। মাটি খুড়লেই এখানে বিশাল আকৃতির পুরোনো আমলের পাথর পাওয়া যায়। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে গ্রামটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ইউনিয়নে। গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর। গ্রামটির বাঁশঝাড়ে এরকমই একটি পাথর পড়ে থাকতে দেখা গেল। পাথর দেখে বোঝা যাচ্ছে এটি যেনো তেনো কোন পাথর নয়, প্রাচীন পাথর। ওজন হবে বেশ। বছরের পর বছর, একই স্থানে রয়ে গেছে পাথরটি। সেখান থেকে আর একটু দূরে জঙ্গলে দেখা মিলল একই রকম আরেকটি পাথরের। এরকম অসংখ্য পাথর বিভিন্ন স্থানে পড়ে রয়েছে। পাথর গুলো কবেকার তা নিয়ে কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা না থাকলেও ইতিহাস বৌদ্ধাদের একটি অংশই মনে করেন নবম-দশম শতকের এসব পাথর। সরেজমিনে পাথরপূজা গ্রামে দুটি ঢিবির দেখা মিলল, সেগুলো আগে অনেক উঁচু ছিল। বর্তমানে তা খোয়ে খোয়ে এখন নিচু হয়ে গেছে। ঢিবিটি একটু আরও মনোযোগ দিয়ে দেখলে বুঝা যাবে এখানে একটি প্রাসাদ ছিল। কোনো কারণে প্রাসাদটি মাটির নিচে দেবে গেছে। ওই জায়গাটি খনন করে একটি বিশাল আকারের পাথর দেখা মেলে। পুরো ঢিবিটির রাস্তা রয়েছে প্রাচীন আমলের ইট ও পাথর। ওই ঢিবিটির একহাত খনন করলেই ইট পাথরের সন্ধান মেলে বলে জানিয়েছেন ওই গ্রামের অনেকই। গ্রামের অনেক বাড়িতে পাথর পাওয়া যায়। সেগুলো বিভিন্ন নকশা করা পাথর। অনেকের পাওয়া সেই নকশা করা পাথর বলে দেই এই গ্রামের প্রাচীনত্ব। ওই গ্রামের একটি মসজিদে গিয়েও অনেক পাথরের খোঁজ মিলে। সেগুলো খোদায় করে নকশা আঁকা রয়েছে। এখানকার প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে একাধিক পাথর। পাথরগুলো গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে বাড়িতে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। পাথরগুলো বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।একেকটি পাথর একেক রকম। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অনেক পাথর গ্রাম থেকে চুরি হয়ে যায়। দূর দূরান্ত থেকে লোক এসে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে। তবুও যেন পাথরের শেষ নেই। কারণ মাটি খুড়লেই মিলছে পাথর।গ্রামটিতে একটি বড় দীঘি রয়েছে। এই দিঘীতে পাথর দিয়ে বাঁধানো একটি ঘাটও হয়েছে। কিন্তু পানি বেশী থাকায় তা পানির নিচে রয়েছে। দিঘির সঙ্গে উঁচু ঢিবিগুলোর সংযোগ সড়কেও রয়েছে। যেটা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে প্রাসাদে যারা বসবাস করতেন তারা ওই সংযোগ সড়ক দিয়ে এই ঢিবিতে আসতেন পানি ব্যবহারের জন্য। অতীতে বরেন্দ্র এলাকায় পানির সমস্যা ছিল, বড় সমস্যা। তাই দিঘি তৈরি করা হয়েছিল। এত বড় দিঘি নিশ্চয়ই প্রজাদের জন্যে বানানো হয়নি। জমিদারদের জন্যেও না। এখানে রাজা-বাদশারাই দিঘি তৈরি করেছিলেন। পাথরপূজা গ্রামের মাটির নিচে হাজার বছর ধরে লুকায়িত পাথরের কোন উল্লেখযোগ্য ইতিহাস রচনা করা হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক কোন তৎপরতা চালানো হয়নি। যার কারণে এখানকার মূল্যবান ইতিহাস পাথরের মত দেবে রয়েছে মাটির নিচে গোপনে। তবে ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের এক অংশ মনে করেন এখানকার পাথরের গঠনের মূল্যমান দেখে কথা পরিষ্কার কোন সাধারন জমিদারদের এসব পাথর দিয়ে প্রাসাদ বানানোর সক্ষমতা নেই। এসব বড় বড় পাথর আনাও এখানে সম্ভব নয়। এসব প্রাসাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজ শাসনের যুক্ত এমন ব্যক্তি অর্থাৎ রাজা বাদশারা ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক কিংবা ভূমিকম্পের কারণে।
কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা খানু সরদারের সঙ্গে, এখানে দুটা ঢিবি রয়েছে। একটু খুড়লেই অনেক বড় বড় পাথর পাওয়া যাবে। শুনা কথা এটা রাজার বাড়ি ছিল। তারা দুই ভাই ছিল। তার পাশে একটি দীঘি রয়েছে। সেখানে ঘাট বাধা আছে।
এলাকার নাজমুল হকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই গ্রামে অসংখ্য পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ওইখানে যে ঢিবিটি আছে সেখানে একটু খনন করলেই বড় বড় পাথর পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান জানান, যদি জায়গাটিতে ঐতিহাসিক কোন নিদর্শনের খোঁজ মেলে তাহলে আমি প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।