ইমরুল হাসান বাবু, টাঙ্গাইল থেকে:
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় অবাধে বিষবৃক্ষ তথা তামাকের চাষ হচ্ছে। এসব জমিতে আগে ভুট্টা চাষ হতো। সিগারেট উৎপাদক কম্পানিগুলোর প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছে। অথচ তামাক চাষ করতে গিয়ে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও তার পরিবারের সদস্যরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলায় ব্যাপক হারে তামাকের চাষ হচ্ছে। যমুনা, ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষা এসব চরাঞ্চলে বর্ষাকালে পলি পড়ে। উর্বর এসব জমিতে আগে মসুর, মাষকলাই, ভুট্টা, বাদাম, কাউন, গম, আলু, আখের চাষ হতো। কিন্তু অনেক জায়গায় কয়েক বছর ধরে তামাকের চাষ হচ্ছে। বহুজাতিক ও দেশীয় টোব্যাকো কম্পানিগুলোর প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা এই ‘বিষবৃক্ষ’ চাষে আগ্রহী হচ্ছে। কয়েকটি বিড়ি, সিগারেট ও জর্দা কোম্পানি তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে আগ্রহী করছে। তারা কৃষকদের অধিক মুনাফার পাশাপাশি সার, বীজ ও সেচের জন্য নগদ টাকা মূলধন (ঋণ) হিসেবে দিচ্ছে। নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় কৃষকরাও তামাক চাষে ঝুঁকছে। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল, গোপালপুর ও সদরের বিভিন্ন এলাকায় তামাকের চাষ হচ্ছে। এসব এলাকার কৃষকরা জানায়, তামাক চাষে প্রতি শতাংশ জমি বাবদ পাঁচ কেজি সার ও প্রয়োজনমতো তামাক বীজ সরবরাহ করছে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো। এ থেকে শতাংশ প্রতি প্রায় এক হাজার টাকার তামাক উৎপাদন করা যায়। কম পরিশ্রমে অধিক লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে। কালিহাতী উপজেলার চরহামজানী গ্রামের তামাক চাষি মো. ইমান আলী জানান, তিনি এ বছর ৫ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন। প্রতি একরে তামাক চাষে খরচ হয়েছে প্রায় এক হাজার টাকা। এ তামাক বিক্রি করে লাভ হবে প্রতি একরে এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা। তামাক চাষ করলে শুধু শরীরে খাটাতে হয়, পুঁজি লাগে না। তামাক শুকিয়ে কোম্পানিকে বুঝিয়ে দিলেই লাভ ঘরে চলে আসে। তিনি জানান, এই জমিতে কলাই, বাদাম ইত্যাদি চাষ করলে মূলধন ছাড়াও বাড়তি শ্রমিক লাগে। খরচ শেষে বিক্রি করে তামাকের চেয়ে অর্ধেকের কম লাভ হয়। তাই তিনি তামাক চাষ করছেন। নাগরপুর উপজেলার ফজল, শরিফ, আজিজুল হক, টাঙ্গাইল সদরের মনছুর মিয়া, শহিদুল মিয়া, আন্তাজ আলী একই ধরনের মন্তব্য ব্যক্ত করেন। তাঁরা জানান, জমি ও শরীরের ক্ষতি হলেও অধিক লাভের জন্যই তাঁরা তামাক চাষ করছেন। তবে কেউ কেউ অভিযোগ করেন, কোম্পানিগুলো তামাক চাষ বৃদ্ধিতে বীজ ও সার সরবরাহ করলেও স্বাস্থ্যহানি রোধে অ্যাপ্রোন বা মাস্ক সরবরাহ করছে না। এ বিষয়ে বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানীর ফিল্ড সুপারভাইজার জিয়াউল হক জিয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি তামাক চাষ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ বলেন, তামাক চাষে সাধারণ চাষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি রাসায়নিক সার ও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করতে হয় এবং তামাক গাছ মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান গ্রহন করে। এতে মাটি দ্রুত উর্বরা শক্তি হারায়। পরবর্তী সময়ে ওই জমিতে অন্য ফসল চাষ করতে মাত্রাতিরিক্ত সার দিতে হয়। তামাকে নিকোটিন থাকায় এটি চাষে শারীরিকভাবেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া তামাক প্রক্রিয়াজাতকালে বায়ু দূষনের ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়।
টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মোঃ সাহাবুদ্দিন খান বলেন, তামাক চাষ, তামাক পাতা শুকানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত করার সঙ্গে যুক্ত থাকলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এমনকি ক্যান্সারের মত মরনব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার বলেন, সরকারি কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় তামাক চাষের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে কৃষকদের নিরুৎসাহী করা হচ্ছে। আগের চেয়ে তামাক চাষ কমে আসছে।
