মাহবুবুর রহমান তুহিন :
‘প্রবীণ’ শব্দটি উচ্চারণ করতেই মনে পড়ে যায় জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী নচিকেতার সেই গানের কথা ‘কেউ বলে বুড়ো ভাম, কেউ বলে পাজি, কেউ এইবার ব্যাটা মরলেই বাঁচি’। এ গান সমাজে প্রবীণদের তাচ্ছিল্যভরে দেখার একটি করুণ ছবি। এই গানেরই যেন একটি প্রতি উত্তর পাওয়া যায় সুমনের একটি গানে ‘আজকে যে বেপোরোয়া বিচ্ছু, ঘরকুনো হয়ে যাবে কাল সে’। সময়ের সাথে আমরা অবিরাম হেঁটে চলেছি। সময় আমাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ় ও বার্ধক্যে উপনীত করে। পর্যায়ে আসীন করে তাই প্রবীণদের অবহেলা নয়, তাঁদের বরণ করে নেয়ার মানসিকতা জাগ্রত করতে হবে। প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে জাতিসংঘ। এ বছর প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য – ‘ Digital Equity for All Ages’. অর্থাৎ সকল বয়সের জন্য প্রাযুক্তিক সাম্য’ প্রযুক্তি এখন জনগণের ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্যদূরীকরণের অন্যতম হাতিয়ার। এ হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে সহজে ও সুলভে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ একদিকে যেমন জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে অন্যদিকে সময় ও অর্থের সাশ্রয় ঘটিয়েছে। এই বাড়তি সময় একদিকে নতুন নতুন চিন্তার দুয়ার উন্মোচন করেছে অন্যদিকে প্রযুক্তি পুরো পৃথিবীকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। এই প্ল্যাটফর্মে তরুণরা যেমন নতুন নতুন গন্তব্য বেছে নিতে পারছে। প্রবীণদের জন্যও এই প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সুযোগ অবারিত করতে হবে। এখানে কোনো বিভেদ ও বৈষম্য করা যাবে না।
২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্টিত ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রবীণ বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ‘সকল বয়সিদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’ এই সম্মেলনে যে এগারোটি বিষয়ের ওপর গূরুত্ব আরোপ করা হয় সেগুলো হচ্ছে (১) সকল প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন, (২) নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র্যদূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন, (৩) নিজেদের সমাজে স্বেচ্ছামূলক কাজ ও আয় বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীণদের ক্ষমতায়ন, (৪) জীবনব্যাপী এবং শেষ জীবনেও সচ্ছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে (৫) প্রবীণরা কোনো একক সমজাতীয় বস্তু নয়– বিষয়টি স্বীকার করে তাদের জীবনব্যাপী শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ, (৬) প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তার বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে, (৭) জেণ্ডারকেন্দ্রিক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যে জেণ্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার; (৮) সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্তঃপ্রজন্ম নির্ভরশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান, (৯) প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা (১০) প্রবীণদের মধ্যে প্রাইভেট সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সবমহলের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সহযোগিতা, (১১) উন্নয়নশীল দেশসমূহে অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলো কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান, এছাড়াও আদিবাসী প্রবীণদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রেখে তাদের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রকাশের সুযোগ দেওয়া। এই সম্মেলনে যে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়েছে সেগুলো হলো : (ক) প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন, (খ) প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি; (গ) প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। সম্মেলনে ২৩৯টি সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর পরই অবহেলিত, পশ্চাৎপদ ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে সংবিধানে তাদের অধিকারের কথা সন্নিবেশিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রবীণ হিতৈষী সংঘকে সুসংগঠিত করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
দেশে বর্তমানে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলে ও আর মাত্র তিনদশকের মধ্যে প্রবীণদের মোট সংখ্যা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ছাড়িয়ে যাবে। ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষকে দেশে প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবে বাংলাদেশে বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছরের বেশি। দেশে ২০৩০ সালের আগেই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে, যার একটি বিশাল প্রভাব পড়বে শ্রমবাজারের ওপর। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ২০৪৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি থাকবে। দেশে এখন ৬৮ শতাংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম; কিন্তু তিনদশক পর প্রবীণদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে দেশের সার্বিক উৎপাদনেও একটি বড়ো ঘাটতি দেখা দিতে পারে। প্রবীণদের যদি সমাজের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বিত করা না হয় তাহলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী একসময় সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান হারে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটি।
বাংলাদেশের সমাজনীতি ও সরকার মোটামুটি প্রবীণ বান্ধব, বিশেষ করে দেশের বিরাট আকারের প্রবীণদের বাস্তব কল্যাণ বিধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ উদ্যোগ, সাফল্য ও সুনাম প্রশংসনীয়। এদেশে ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত অবসরকালীন পেনশন ব্যবস্থারপর ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে যুগান্তকারী বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি প্রচলন, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ এবং মাতাপিতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯-৬০ করা, পেনশন সুবিধা সম্প্রসারণ, মাতাপিতাকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবারের সদস্য ৪ থেকে ৬ জনে উন্নীতকরণ, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রবীণ স্বাস্থ্যসেবাখাতে অনুদান বৃদ্ধি করাসহ প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠনের উদ্যোগ প্রবীণদের সুরক্ষায় সরকারের দায়বদ্ধতার প্রত্যক্ষ উদাহরণ।
দেশের বয়ঃজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে ‘বয়স্কভাতা’ কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ২০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২২ লাখ ৫০ হাজার এবং জনপ্রতি মাসিক ভাতার হার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৯ লাখ বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়।
বর্তমানে বয়স্কভাতা কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা হলো- ২০১৩ সালে প্রণীত বাস্তবায়ন নীতিমালা সংশোধন করে যুগোপযোগীকরণ, অধিকসংখ্যক মহিলাকে ভাতা কার্যক্রমের আওতায় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে মহিলাদের বয়স ৬৫ বছর থেকে কমিয়ে ৬২ বছর নির্ধারণ, উপকারভোগী নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তকরণ, ডাটাবেজ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ১০ টাকায় ভাতাভোগীর নিজ নামে ব্যাংক হিসেব খুলে ভাতার অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে।
কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরঞ্চ সবাইকে নিয়ে বিশ্বসমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য দলিলের মহাত্মা এখানেই। প্রবীণরা সমাজে বটবৃক্ষের মতো। তাদের সারাজীবনের অভিজ্ঞতা তরুণদের চলার পথের পাথেয়।
আজকের প্রবীণরাই তরুণ বয়সে জীবনকে তুচ্ছ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পরবর্তী প্রজন্মকে একটি স্বাধীন স্বদেশ উপহার দিয়েছে। এই তরুণরাই তারুণ্যের স্পর্ধিত অহংকারে সমস্ত ব্যারিকেড ভাঙার শপথ উচ্চারণ করেছে। রক্তস্নাত পলল ভূমিতে মুক্তির বীজবপন করেছে। বুলেটের সামনে গিয়ে বলেছে ‘জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়’। সেই তরুণরাই আজকে প্রবীণ। আমাদের পথনির্দেশক। বয়সের ভার ন্যুব্জ। তাদেরকে অবহেলা মানে আমাদের আত্মা ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। তাই আজকের নবীনদের শেকড় সন্ধানী হতে হবে। তবেই তারা দেশের জন্য যেমন আরও নিবেদিত হবে এবং যারা অগ্রজকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখবে।
সময় তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর। তথ্যপ্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারে জীবনে এখন নবসুন্দর গতিধারা। এ গতিধারায় নবীন ও প্রবীণ সবাই উদ্ভাসিত হবে। আমরা বলবো ‘নবীন-প্রবীণ গড়বে দেশ, ডিজিটাল হবে বাংলাদেশ’।
লেখক : মাহবুবুর রহমান তুহিন, তথ্য কর্মকর্তা, তথ্য অধিদফতর