ডিসেম্বর, ২০২০ থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজ চলছে। ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ জন, ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বারে ১ হাজার ৮০৪ এবং ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি যথাক্রমে আরও ১ হাজার ৭৭৮ ও ১ হাজার ৪৬৪ জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হলেও এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে বছরের পর বছর জায়গা দেওয়া সম্ভব নয়।
আশা করা হয়েছিল মিয়ানমার দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর এজন্য প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু চার বছরেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার আগ্রহ দেখায়নি।
দু-একবার উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি। আন্তর্জাতিকভাবেও মিয়ানমার খুব চাপের মুখে পড়েনি। উল্টো চীনসহ অনেক দেশই কার্যত নানাভাবে চীনের পাশেই দাঁড়িয়েছে। সব দেশই নিজ নিজ স্বার্থ দেখেছে। মানবতা দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশ পড়েছে বিপাকে। জাতিসংঘও বড় দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অবস্থান যত দীর্ঘ হবে, সমস্যাও তত বাড়বে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে এখন নিবন্ধটিও রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ বলে জানা গেছে। তারা নানা সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে। ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পুনর্বাসন কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে বলেও মনে হচ্ছে না। প্রথম দিকে ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের আপত্তি বা অনীহা ছিল।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু দায় বা চাপ যেহেতু বাংলাদেশের সেহেতু বাংলাদেশ স্থানান্তরের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই দেখেছে। প্রশ্ন উঠছে, সাড়ে ১১ লাখের মধ্যে মাত্র এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে কী এমন লাভ হবে? রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির কারণে কক্সবাজারে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। নিজেদের মধ্যে যেমন তাদের কিছু বিবাদ আছে, তেমনি স্থানীয়দের সঙ্গেও তারা বিরোধে জড়াচ্ছে। হিংসা-হানাহানির ঘটনাও ঘটছে। রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে বিভিন্ন গোষ্ঠী দেশের শান্তি-স্থিতি-নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও ঝুঁকি তৈরি করছে কিনা, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সরকারের কাছে নিশ্চয়ই সব তথ্য আছে।
তাই সরকার রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় গাদাগাদি করে না রেখে আলাদা রাখতে আগ্রহী। ভাসানচরের মতো আরও জায়গা থাকলে আরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা স্থানান্তর সম্ভব হতো। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির জনবহুল একটি দেশে কয়েক লাখ বাড়তি মানুষের চাপ কোনো বিবেচনায়ই ছোট বিষয় নয়। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতা না করে সবারই উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারসহ নানা ত্রাণসহায়তা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু অন্য কোনো দেশ তো তাদের আশ্রয়ের জন্য জায়গা দিচ্ছে না। মানবিক কারণে যে দেশ বিপদে পড়া এতগুলো মানুষকে ঠাঁই দিয়েছে সেই দেশের ওপর কোনো নতুন চাপ তৈরি না করে যে দেশ বা সরকার এই মানুষদের দেশত্যাগী হতে বাধ্য করেছে, তাদের ওপরই চাপ দেওয়া উচিত, যাতে তারা নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। পুনর্বাসন নিয়ে বিতর্ক বা প্রশ্ন না তুলে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারেই সবার মনোযোগী হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের ওপর জবরদস্তি করছে না। রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল ভাসানচরে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সেখানকার অবস্থা ভালোভাবে দেখেশুনেই সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে।
ভাসানচরকে আধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সাজানো হয়েছে। তিন হাজার একর জায়গায় চার পাশে বাঁধ নির্মাণ করে রোহিঙ্গাদের জন্য যে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে আছে ১ হাজার ৪৪০টি ঘর। প্রতি ঘরে চার সদস্যের ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। আছে রান্নাঘর এবং টয়লেট সুবিধা। পরিবেশবান্ধব এ প্রকল্পে আছে বায়োগ্যাস এবং সোলার প্যানেল।
বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার সব সুবিধাই ভাসানচরে নিশ্চিত করা হয়েছে। বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের সময় যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তার ১২০টি সাইক্লোন শেল্টারও বানানো হয়েছে। ভাসানচরে বসবাসকে যারা বাইরে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রচার করছেন, তারা প্রকৃত তথ্য না জেনেই সেটা করছেন।
কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি ভোরেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশটির বেসামরিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান নেতা এবং স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
গত ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ব্যাপক জয় পায় সু চির দল এনএলডি। ভোটে প্রতারণার অভিযোগ এনে ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউএসডিপি ( ইউনিয়ন সলিডিরাটি অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট পার্টি) ।
দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের পরিণতিতেই ক্ষমতার হাত বদল বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর টানা ৪৯ বছর সামরিক শাসনের অধীনে চলেছে মিয়ানমার। ২০১১ সালে সু চির দল ক্ষমতায় এলেও সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব শিথিল হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছাকে না মেনে সেনাবাহিনী তাদের দাপট দেখিয়েছে। এটা দুঃখজনক ঘটনা।
রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে সেনাবাহিনী প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্যই সেনা কর্মকর্তারা আবার ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিল এবং এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে সামান্য আশা দেখা দিয়েছিল তা-ও আরও দূরে সরে গেল বলে মনে করার কারণ আছে।
লেখক : বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।