দীর্ঘ এক বছর ধরে করোনাকালীন সময়ে প্রাণঘাতির পরে অন্য যে বড় ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হয়েছি তা হলো শিক্ষার ক্ষতি| আর্থিক, ব্যাবসায়িক ও অন্যান্য ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি ও শিক্ষাজনিত কিছু কিছু পরোক্ষ ক্ষতি কি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে? কখনোই হয়তো সম্ভব হবে না| যেমন শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শিক্ষকতা পেশা থেকে ঝরে পড়া, শিশুর প্রথম শিক্ষার বিড়ম্বনা, বাল্যবিবাহ, উচ্চশিক্ষা ও চাকরি হতে বঞ্চিত হওয়া, শিক্ষার প্রতি অনীহা ও অনাস্থা, শিক্ষার মর্যাদার সংকট, সৃজনশীল ও মেধা বিকাশের জট, মানসিক শিক্ষার সংকট, মানবিক শিক্ষার ঘাটতি ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের শিক্ষার অভাব| আবার যদি দীর্ঘমেয়াদী সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়, হয়তো তাহলে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে|
বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের এসব অপূরণীয় ক্ষতি ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ গঠনের নিরব হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রতিটি দেশের কাছে| এছাড়াও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছ|
বেসরকারি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিলেও দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম থেমে আছে| করোনা মহামারি থামার কোন লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না| টিকা আবিষ্কার হলেও টিকার সংকটের কারণে আগামী এক বছরে নিউ নরমাল বা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশাও কোন দেশ করতে পারছে? তাহলে আগামী দিন গুলোতে কি শিক্ষার এই অপূরণীয় ক্ষতির কারণে শিক্ষার মহাসংকট আরো গভীর থেকে গভীরতর হবে?
এখনই যদি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা না হয়, তাহলে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর সবার কাছেই পাওয়া যাবে| শিক্ষা কার্যক্রম চালু না হলে অনলাইন বা দূর শিক্ষণ পদ্ধতিতে যেভাবে আধো আধো শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, আগামী দিনগুলোতে যদি এভাবেই চলতে থাকে তাতে শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতির মহামারি ঠেকানো সম্ভব হবে না| সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে যে সঠিক অবকাঠামোর অভাবে বিদ্যালয়ের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অনলাইন বা দূর শিক্ষণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না|
ফলে অবকাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা (ডিভাইস এবং ইন্টার্নেট) তৈরি বা বৃদ্ধি না করলে দূর শিক্ষণ শিক্ষা পদ্ধতি তেমন কোন কাজে আসবে না| অন্য একটি জরিপে দেখা গেছে যে দেশে দারিদ্র্যের হার অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গিয়েছে| এ দুটো জরিপের ফলাফল যে উদ্বেগের জায়গায় তৈরি করেছে সেটি হল দরিদ্র ও টানাপোড়ন পরিবারের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার এবং বাল্যবিবাহের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা তৈরি হওয়া|
কোমলমতি শিশুরা শিক্ষা জীবনের প্রথম বছর শুরু করতে পারছে না, এ নিয়ে অভিভাবকেরা অনেক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন| শিক্ষিত অভিভাবকেরা নিজেরা এ শিক্ষা চালিয়ে নিলেও প্রত্যন্ত গ্রাম গঞ্জে দরিদ্র, অশিক্ষিত কিংবা কম শিক্ষিত পরিবারে এটি ঘটছে না একেবারেই| ফলে তাদের জীবন থেকে একটি অথবা দুটি বছর এমনি এমনি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে|
এছাড়াও খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কার্যক্রম থেমে থাকার কারণে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে| শহরের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ওজন বৃদ্ধি, মানসিক অস্থিরতা, এমনকি নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে| ইন্টারনেট বা অনলাইনে বেশি বেশি সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ বেড়েছে, যার অসৎ ব্যবহারে অনেকে নিজের বিপদ নিজেই নিয়ে আসছে|
এসএসসি এবং এইচএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার মানসিক দৃঢ়তা প্রমাণের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, যা পরবর্তীতে উচ্চতর পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে অনেকের ক্ষেত্রে|
স্কুল থেকে কলেজে বা কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অবতীর্ণ হওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এর একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়বে| ইতিমধ্যে যারা কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হয়ে শ্রেণিকক্ষের ক্লাসের সুযোগ না পেয়ে অনলাইনে ক্লাস করছে, তাদের পড়াশোনার একটা নেতিবাচক মানদণ্ড তৈরি হচ্ছে| স্কুল-কলেজে বদলি বা নতুনভাবে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বাড়তি অস্থিরতা তৈরি হয়েছে|
আগামী এক মাসের মধ্যে পরীক্ষা সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম চালানোর অনুমতি পেলেও ধারণা করা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যে প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম ৯-১০ মাস সেশন জটে পড়বে| প্রথম হতে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের এই সেশনজট পরবর্তীতে কমানোর সুযোগ থাকলেও চতুর্থ বর্ষ বা চূড়ান্ত সেমিস্টার এবং মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা করার সুযোগ একেবারেই নেই| ফলে তাদের চাকরি খোঁজার সময়কালের ব্যাপ্তি কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়েছে|
ইউনেস্কোর এক সমীক্ষা মতে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি শিক্ষার্থী, যা মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি করোনা মহামারির কারণে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে| বর্তমানে ৩১ টি দেশে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে যা সর্বোচ্চ ১৯০ টি দেশে ছিল গত বছরের এপ্রিল মাসে| অন্যদিকে বর্তমানে আংশিক চালু রয়েছে এমন দেশের সংখ্যা ৪৮|
সারাবিশ্বে প্রতিটি দেশে গড়ে চৌদ্দ সপ্তাহ শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিল, আংশিক চালুসহ হিসাব করলে যেটি গড়ে ২২ সপ্তাহ যা সারা বিশ্বের দেশ গুলির স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম সময়কালের দুই-তৃতীয়াংশ| ল্যাটিন আমেরিকার দেশ গুলোতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা কার্যক্রম আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিল, গড়ে যেটা ২৯ সপ্তাহ, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে গড়ে ২৮ সপ্তাহ উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে, তৃতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে গড়ে ২৭ সপ্তাহ মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে| ওশেনিয়া অঞ্চলের দেশ গুলোতে ছিল সবচেয়ে কম যা গড়ে সাত সপ্তাহ|
বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে চালু রয়েছে ১০১ টি দেশে যার অনেক গুলির করোনা পরিস্থিতি আমাদের দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির চেয়েও খারাপ| আমাদের দেশেও ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে| যা অত্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে বলে অধিকাংশ মানুষই মনে করেন|
বাংলাদেশে গত বছর ১৭ মার্চ হতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় খারাপ অবস্থান| ভারতের শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দিন হতে বন্ধ হয়েছে কিন্তু সে দিক থেকে পাকিস্তান অনেকটা এগিয়ে| যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অতিসত্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে শিক্ষা মহাসংকট সামাল দেওয়া সহজ হবে|
সারাবিশ্বে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ মিলে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউনেস্কো| আমেরিকাতেও শিক্ষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দিয়ে বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ব্যাপক আলোচনা চলছে|
অভয় ও নিরাপদে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানাবে যেকোনো দেশের প্রতিটি শিক্ষক, এটি আমার বিশ্বাস| সম্মুখসারির যোদ্ধা ও বয়স্কদের টিকা দেওয়ার পর বা পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষকদেরও টিকা দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি|
লেখক : ড. মো. হাসিনুর রহমান খান, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।