সিলেটে বন্যার পরিস্থিতির অবনতিতে চিকিৎসা স্থগিত করে দেশে ফিরছেন সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী । এক সপ্তাহ ধরে বন্যা কবলিত ৭ লাখ মানুষ। গত ২৭ মে জেলার ৫টি উপজেলায় দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। পর্যায়ক্রমে ৯টি উপজেলায় ও সিলেট মহানগরে ছড়িয়ে পড়ে বন্যা। জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মেয়র চিকিৎসা স্থগিত করে আজ দেশে ফিরছেন। সিলেট জেলার সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও বিশ্বনাথ উপজেলার ৬ লাখেরও বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন। এমন তথ্য দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এছাড়া সিলেট মহানগরের অন্তত ২৮টি ওয়ার্ডের প্রায় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এ তথ্য নিশ্চত করেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) সূত্র। ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ভারতীয় ঢলে ২৭ মে থেকে সিলট জেলার কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলায় দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি উপজেলায় বন্যার সৃষ্টি হয়।
শুক্র ও শনিবার বৃষ্টি এবং উজানের ঢল থামায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। তবে রোববার ও সোমবার ফের সিলেটে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় বেড়ে যায় নদ-নদীর পানি। সোমবার (৩ জুন) পর্যন্ত জেলার ১৩টির মধ্যে ৪টি (দক্ষিণ সুরমা, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) ছাড়া বাকি সব উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় ৬ লাখ ১৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী। প্লাবিত হয়েছে ৯টি উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের ৭৬১টি গ্রাম।
এ তথ্য দিয়ে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোতে মোট ৫৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে বর্তমানে ১ হাজার ৩ শ ৮৪ জন অবস্থান করছেন।
সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান গণমাধ্যমকে জানান- উপজেলা পর্যায়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গত ১২ ঘন্টায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ২৭৮ জন ক্ষতিগ্রস্থ তাদের বাড়িঘরে ফিরে গেছেন। তবে রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে সিলেট জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সিলেট নগরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। অতিবৃষ্টি এবং উজানের ঢল নামা পুনরায় শুরু হলে পরিস্থিতি আবারও অবনতি ঘটত পারে। সার্বিক পরিস্থিতির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান- বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে শুকনো ও রান্না করা খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে।
এদিকে রোববার (২ জুন) রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাতে সিলেট মহানগরের অন্তত ২৮টি ওয়ার্ড বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন প্রায় ১০ হাজার পরিবারের ১ লাখ মানুষ। তবে সোমবার বিকেল থেকে পানি কমতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
প্লাবিত এলাকাগুলো সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে স্থানীয় কাউন্সিলরদের মাধ্যমে বন্যায় আক্রান্তদের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। রাতে ওইসব এলাকায় রান্না করা খাবার দেওয়া হয়। এমনটা জানিয়েছেসিলেট সিসিক সূত্র।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রোস্টার ডিউটি পালন করবেন সিসিকের কর্মকর্তাগণ। জরুরি সেবায় সিসিকের কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর (০১৯৫৮ ২৮৪৮০০) ২৪ ঘন্টা চালু রয়েছে । সিসিক সূত্র আরো জানায়, সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় মহানগরের ছড়া-খাল ভরে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের ওয়ার্ডগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত মহানগরের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সিসিক। আশ্রয় কেন্দ্রসহ ত্রাণ সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে সিসিক কতৃর্পক্ষ। ইতিমধ্যে ৫টি ওয়ার্ডে আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে।
নগরের ১৫ নং ওয়ার্ডে কিশোরী মোহন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, রামকৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়, বসন্ত মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ও মওদুদ আহমের বাসায় আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। ১৩ নং ওয়ার্ড মির্জা জাঙ্গাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ২৪ নং ওয়ার্ড তেররতন স্কুল, ওমর শাহ স্কুল ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ঘাসিটুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউসেফ ঘাসিটুলা স্কুল, জালালাবাদ মডেল স্কুল, মঈনুদ্দিন মহিলা কলেজ এবং কানিশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে রোববার রাতের টানা বৃষ্টিতে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পানি ঢুকে পড়ে। এতে কলেজে সোমবারের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এছাড়া হাসপাতালের নিচতলার তিনটি ওয়ার্ডে পানি জমে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও রোগী সংশ্লিষ্টরা। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিও নেমে যায় বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, রোববার রাত ও সোমবার সকালের বৃষ্টিতে হাসপাতালটির প্রবেশ-ফটক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ভবন, কলেজ ফটক, ছাত্রীনিবাস ও ছাত্রাবাসে রাতে পানি উঠে। এছাড়া হাসপাতালের নিচতলায় প্রশাসনিক ব্লকের ২৬, ২৭ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে পানি ঢুকে। আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকায় প্রশাসনিক ব্লকের কাগজপত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে চাপ বেশি থাকায় মেঝেতে অবস্থান করা রোগীরা কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েন। প্রতিষ্ঠানটির পেছনের ছড়ার পানি উপচে ক্যাম্পাস ও হাসপাতালে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে পানি জমে থাকায় সোমবারের ক্লাস ও পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। অবস্থা অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক সৌমিত্র চক্রবর্তী সোমবার রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের নিচতলায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিলো। হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ডে পানি ঢুকেছিলো। এতে চিকিৎসাসেবায় সামান্য ব্যাঘাত ঘটছিলো। এসময় মেঝেতে থাকা রোগীদের শয্যায় তোলা হয়। প্রশাসনিক কক্ষ এবং বারান্দাতেও পানি ঢুকেছিলো। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি নেমে যায়। আর পানি ঢুকলেও কোনো জিনিপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।