রাজিবুল হক সিদ্দিকী, কিশোরগঞ্জ থেকে : কিশোরগঞ্জে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভাটি অঞ্চলের সরকারি সেবাদানকারী একমাত্র ৫০০ শয্যার হাসপাতাল। হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই নানা অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালের জন্য আউটসোর্সিংয়ে কর্মী নিয়োগেই দুই কোটি টাকার বেশি ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত আছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কিছু চিকিৎসক নেতাও। বিষয়টি জানাজানি হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট হাসপাতালের বহির্বিভাগের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় তৎকালীন পরিচালক ডা. সাইফুর রহমান হাসপাতালের ৯২ জন আউটসোর্সিং কর্মীকে কাজ করার সুযোগ দেন। পরে এ সংখ্যা বেড়ে ১০৩ জনে দাঁড়ায়। মন্ত্রণালয় থেকেও ১০৩ জনের অনুমোদন দেওয়া হয়। তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তত কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে বলে সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ডা. সাইফুর রহমান অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে নতুন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান উপপরিচালক ডা. সৈয়দ এ কে এম মঞ্জুরুল হক। তার সময় থেকেই করোনা মহামারি শুরু হলে সৈয়দ নজরুল মেডিকেলকে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে বহির্বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ থাকে। তারপরও থেমে থাকেনি আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগ। পরিচালক পদে ডা. সৈয়দ এ কে এম মঞ্জুরুল হক যোগদানের পরদিন থেকেই আউটসোর্সিংয়ে জনবল বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তা ১৮১ জনে দাঁড়ায়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি গত ২৯ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার আগে ঘুষের বিনিময়ে ৩৫ জনকে তালিকাভূক্ত করেন। এ ৩৫ জনসহ আউটসোর্সিংয়ে বর্তমানে মোট কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৬ জনে। অনুমোদিত ১০৩ জনের বিপরীতে ২১৬ জন হওয়ায় জুন মাসের পর তারা কোনো বেতন পাচ্ছেন না। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সরকারের নির্দেশে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা পূর্ণাঙ্গভাবে (ইনডোর-আউটডোর) চালু হলে আউটসোর্সিং জনবল তালিকাভূক্তির বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় উঠে আসে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান সম্প্রতি কিশোরগঞ্জে এলে নানা মাধ্যম থেকে তিনি আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি জানতে পারেন। একাধিক মতবিনিময় সভায় তিনি এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
অভিযুক্ত আরেক সাবেক পরিচালক ডা. সৈয়দ এ কে এম মঞ্জুরুল হক বলেন, ১০৩ জন অনুমোদিত কর্মী ছিল। তার বাইরে প্রতিদিন মাস্টাররোলে আরও ৯২ জন তালিকাভুক্ত হয়। এ তালিকা কে করেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগেই তালিকা করা হয়েছিল। তবে তার সময়েও বেশ কিছু তালিকাভুক্ত হয়েছে। তিনি জানান, বিভিন্ন পেশার হাইপ্রোফাইল লোকজন তাকে ব্যক্তিগতভাবে এবং ফোনে বলেছেন। তাদের অনুরোধ ও সুপারিশে আউটসোর্সিংয়ে কিছু লোক তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
হাসপাতালের কয়েকজন আউটসোর্সিং কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাকরি পাওয়ার জন্য তারা দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছেন। কাকে টাকা দিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তারা কারও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
জেলা বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল ওয়াহাব বাদল বলেন, আউটসোর্সিং নিয়োগে সরকারের নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। পরিচালক ডা. সাইফুর রহমানের সময়ে প্রথমে দুর্নীতি শুরু হয়। কোনো পরিচালকই দায় এড়াতে পারেন না। শুদু আউটসোর্সিং নয়, যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করলে দুর্নীতির মাত্রা আরও ব্যাপক হবে।
হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ডা. এহসান কবীর মুকুল বলেন, তিনি গত ৩০ অক্টোবর হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে যোগদান করেছেন। আউটসোর্সিংয়ে ২১৬ জনের তালিকা তিনি পেয়েছেন। আরও ৩০৯ কর্মী অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, আউটসোর্সিংয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন।