একটি মহানগরের বাসিন্দারা কি চান, তা সেই মহানগরের মেয়র জানেন। এটা ধরেই নেয়া হয় যে তারা জানেন। কারণ যিনি মেয়র পদে অভিষিক্ত হয়েছেন, মহানগরের সব তথ্যউপাত্ত থাকে তারই নখদর্পণে। সেই যুক্তিতে আমরা জানি ও আমরা বলবো, ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র জানেন তাদের সমস্যা-সংকট ও তার সমাধান পরিকল্পনার নীলনকশা। কেউ কেউ বলবেন তাদের উন্নয়ন ধারা ও ধারণার রোডম্যাপ তারা নির্বাচিত হওয়ার আগেই আগাপাশতলা জেনেই ওই পদে অভিষিক্ত হয়েছেন।
ঢাকা মহানগর ক্রমবর্ধমান। এর পরিধি বাড়ছে এবং বাড়ছে তার নানামুখি সমস্যাও। এই মহানগরের সবচেয়ে পুরোনো সমস্যার একটি হচ্ছে মশা। আর আরেকটি হচ্ছে এই মহানগর বাড়ছে অপরিকল্পিতভাবে। আসলে, পরিকল্পনা নেয়া হয় বটে, তবে তার সাইজ ছোটো এবং তেমন কোনো দীর্ঘমেয়াদী নয়। নেই এই মহানগরের রোড বা সড়ক পরিকল্পনাও।
রোড় প্লানিং যে একটি মহানগরের অন্যতম প্রধান কাজ, সেটা বুঝলেও পরিকল্পনার দায়িত্বপ্রাপ্তগণ ক্ষমতাসীনদের চোখরাঙানিতে তটস্থ হয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না বা করেন না লাভজনক [ঘুষজনক] পজিশন থেকে বদলির ভয়ে।
ভয়কে জয় করতে পারেন না বলেই কোনো গৃহিত পরিকল্পনা নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয় না। আবার এই সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢিলেমি করে এর মেয়াদ বাড়ানোও একটি লাভজনক নেশা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। বাস্তবায়ন মেয়াদ বাড়ানোর সাথে সাথে দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাবানেরা প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ান কয়েকগুণ। ফলে বাড়তি ব্যয় থেকে থোক হিসেবে অর্থ লোপাট করারও একটি রাজনৈতিক উন্নয়ন নেশা হিসেবে চলে আসছে।
এই নেশাটাই মহানগরের মশানিধনের রোডম্যাপের সাথে যুক্ত হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। ঠিক কবে থেকে ঢাকা মহানগরে মশার উপদ্রব চলছে তার কোনো উপাত্ত বোধহয় মহানগরের করনিক সম্প্রদায়ের হাতে নেই বা ছিলো না কখনোই। ‘করনিক’ শব্দের অর্থ আভিধানিকরা কি রেখেছেন মনে নেই আমার। তবে, যিনি বা যারা কাজ করেন, মূলত তারাই ‘করনিক’। কেরানি থেকে জাত হলেও এর পরিধি ব্যাপক বলেই আমি মনে করি।
তো, একটি প্রচলিত বাক্য আমরা শুনে আসছি সুদূর অতীত থেকে ‘রেতে মশা দিনে মাছি/এই নিয়ে ঢাকা আছি।’ এই বাক্যটি রচিত হয়েছে শত শত বছর আগে যখন এই মহানগর ‘মহানগর’ হিসেবে রূপ পায়নি। তার মানে মোঘল আমলেও ঢাকায় মাছি আর মশার দাপট ছিলো এবং বাসিন্দরাও তাদের হাতে অত্যাচারিত হতো।
আমি জানি না ঢাকা মহানগরের মশক উৎপাদন কেন্দ্রগুলো কোথায় অবস্থিত। আগে যে শুনতাম, ড্রেনগুলোতে মশকদের লার্ভাই মশা জন্ম দিয়ে চলেছে। শুধুই যে মজা-পঁচা ড্রেনগুলোতে মশা জন্মাচ্ছে, তাই নয়, নালা-ডোবা, খাল ও মজে যাওয়া বিল-ঝিলও এর অন্তর্গত বলা যায়। ওই সব জায়গায় আমরা অনেকবারই ওষুধ ছিটাতে দেখেছি সিটির মশক নিধন কর্মবীরদের। কিন্তু মশা মরেনি কিংবা তারা মরার ভাণ করে শুয়ে থাকে।
আমরা ভাবি, এইবার মশার হাত [মশাদের হাত নেই]থেকে আমরা বাঁচলাম। কিন্তু না, ড্রামার শেষ অংকে এসে সেই মশকদলের জেগে ওঠে উৎপাদনের মাঠে নামতেও আমরা দেখে আসছি। মশক নিধন কর্মবীরদের নেতারা জোরগলায় বলেন তারা শত শত কোটি টাকা প্রতিবছর ব্যয় করছেন ‘মারণওষুধ’ কেনা বাবদ। সেতথ্য যথার্থ। কিন্তু সেই ওষুধে কাজ হয় না। তারপরও প্রতিবছর সেই ওষুধই কেনা হয় এবং কর্মীবাহিনী তা ছিটিয়ে চলেন।
এই গল্পটা এতোটাই সহজ ও সরল যে এই মহানগরে জন্ম নেয়া শিশুরাও তা ভালোভাবে জানে। এ-নিয়ে দীর্ঘ রচনা ফাঁদার প্রয়োজন নেই। তবে, আমরা যদি না লিখি, যদি মেয়র অফিসকে না জানাই যে ঢাকার মশকবাহিনীর অত্যাচারে মহানগরবাসী অতিষ্ঠ, তাহলে তারা সেই যন্ত্রণা নিরসনে সরব হবেন কেমন করে? তারা তো ওষুধ কিনছেন, ছিটিয়ে দিচ্ছেন চিহ্নিত জায়গায়। তাহলে মশক কেন নির্মূল হচ্ছে না। এর একটাই উত্তর হচ্ছে, ওষুদের কোয়ালিটি অত্যন্ত খারাপ।
যদি প্রমাণিত হয় যে ওষুধ ভালো তাহলে সেই ওষুধ পরিমাণ মতো ব্যবহার না করে পানি মিশিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি ওষুধ চোরাই পথে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। তারা সিটির সমস্যা সমাধানের চেয়ে নিজেদের লাভটাই বেশি দেখেন। সরকারি অফিসের দুর্নীতির হোতারাও দেশ ও জনগণের কল্যাণ দেখেন না, নিজেদের লাভ দেখেন। আবার অনেকেই নিজেদের লাভকে দেশেরই লাভ বলে ভাবেন। এ-রকম ভাবনার বহু জাল ছড়িয়ে আছে নানা সেক্টরে। সিটি তার একটি।
এই সমস্যা থেকে কি আদৌ মুক্তি সম্ভব? না, আপাতত সে-রকম কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। মহানগরের ভেতরে অনেক উন্নয়ন অবকাঠামো চোখে পড়ছে। সেই উন্নয়ন নিয়ে বেশ বগল বাজাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। আমরাও বাহবা দিচ্ছি। কেন না, চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন অবশ্যই আমাদের উৎসাহী করে তোলে। আশার আলো জ্বেলে দেয়। কিন্তু এই মহানগরের রূপ ঝলমল আলোর নিচেই যে মশক-অন্ধকার জনজীবনকে নরক করে তুলেছে, সে ব্যাপারে কি উন্নয়ন তরিকায় কোনো প্রকল্প নেই। যারা বিশেষজ্ঞ এ-বিষয়ে তারা বলতে পারবেন, কোন পথে মহানগর থেকে মশা দূর করা নির্মূল করা যায়।
মহানগর যতোই রূপেগুণে ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠুক না কেন, মশা নির্মূল না করতে পারলে সাতমণ দুধের মধ্যে এক ফোটা গো-চুনা দুধের পরিণতি কেমন করে তা আমাদের জানা আছে। আমরা উন্নয়ন ধারার সুফল পেতে চাই।
লেখক: ড. মাহবুব হাসান।