নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ছাত্র রাজনীতির স্বরূপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে আমার। ক্যাম্পাসে অধ্যয়নের সময়ে আমি দেশের প্রচলিত প্রধান দুটি রাজনৈতিক ধারার ছাত্র সংগঠনের আমলই পেয়েছিলাম। সময়ের পরিক্রমায় আজ আমি একটি আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সাধারণ ছাত্রদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, নিজেদের দলীয় কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা, টর্চার সেল সংস্কৃতি, সিট বাণিজ্য, অস্ত্রের ঝনঝনানি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য ও দখলদারিত্ব বজায় রাখতে প্রশাসনের প্রশ্রয় ও আনুকূল্য লাভ, এমনকি ছাত্র হত্যার মতো অমার্জনীয় অপরাধ সংঘটনে এদের কারও মধ্যে কোনো ধরনের ভিন্নতা আমার চোখে পড়েনি।
কাগজ-কলমে একটি আবাসিক হলের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের দায়িত্ব পেয়েও শুধু তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির অযাচিত দাপটের কারণে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেও হল প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হল পরিচালনা করতে গিয়ে বারবার বাধাগ্রস্ত হই। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের প্রায় সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে একই চিত্র ও বাস্তবতা বিদ্যমান এবং সেসব আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ আমার মতোই অসহায়ত্ব নিয়ে নামকাওয়াস্তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যাত্রা শুরু করলেও এটি এখন মধ্যগগনে তাতিয়ে ওঠা সূর্যের মতোই কিরণ ছড়াচ্ছে। ‘বৈষম্যবিরোধী’ শব্দ বিশেষ তাৎপর্যও বহন করে বটে। সদ্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ থেকে দরিদ্র-অসহায়, অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাতা চালুসহ দেশকে উন্নয়নের ছোঁয়ায় গোটা বিশ্বে উচ্চকিত আসনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে– এটি যেমন স্বীকার্য; তেমনি এ কথাও অস্বীকারের উপায় নেই– দেড় দশক ধরে সরকারি দলে বৈষম্য, দুর্নীতি, জনবিচ্ছিন্নতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকিং খাতের অবনমন, মূল্যস্ফীতি ছাড়াও আরেকটি গুরুতর যে জনরোষ, প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের ছাত্র সংগঠনকে পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহার এবং এদের সব ধরনের কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। সরকার ও প্রশাসনের যূথবদ্ধ আশকারা পেয়ে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে এসব ছাত্র সংগঠন। অবশ্য সব সরকারের আমলেই তাদের নিজ নিজ ছাত্র সংগঠন এমন চর্চাই করে এসেছে।
আবাসিক হলের ডাইনিং-ক্যান্টিনগুলোতে বছরের পর বছর বাকিতে খাওয়া কথিত ছাত্রনেতা ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত আসনে ওঠার ক্ষেত্রেও তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ আবাসিক হলে ছাত্রদের জন্য সিট বরাদ্দ দেওয়া এবং ছাত্রত্ব শেষে সিট প্রত্যাহার করা প্রভৃতি দায়িত্ব পালনের কথা প্রশাসনের। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো এখানে ছায়া প্রশাসনের মতো ভূমিকা নিয়ে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে হল প্রশাসনকে পাত্তাই দেয় না। যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে আসছে। এই ন্যক্কারজনক অনধিকার চর্চার সঙ্গে জড়িত ছাত্র নামধারী বেশির ভাগেরই ছাত্রত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা বহাল তবিয়তে ক্যাম্পাসে নিজেদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। নিজেদের অপ্রতিহত ক্ষমতাধর বড় ভাই-বড় আপু মনে করে দাম্ভিক আত্মশ্লাঘা অনুভব করে।
আমি খুব করে চাই আবাসিক হলের প্রত্যেক ছাত্র নির্ভয়ে হলের ফটক দিয়ে প্রতিদিন সকালে ক্লাসে যাক। ক্লাস করা বাদ দিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কোনো বড় ভাই-বড় আপুরা সেখানে তাদের কর্মী বাহিনী নিয়ে বাধ্য করবে না। এদের জিজ্ঞাসা আর জবাবদিহির মুখে আটকে গিয়ে দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে ক্লাসের হাজিরা খাতায় নিজের উপস্থিতি আজকে আর তোলা গেল না কিংবা আগের দিন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে কর্মসূচিতে যাইনি ইত্যাকার ভয় আর নিরাপত্তাহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হোক নিরীহ ছাত্ররা। অন্তর্কোন্দলে বহুধা বিভক্ত একই ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে নিষ্প্রয়োজন মিছিল-মহড়ায় যেভাবে বড় ভাই পরিচয়ধারী কথিত ছাত্রনেতারা সাধারণ ছাত্রদের চোখ রাঙানি ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করে, তাতে তারা ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ। দেয়ালে এদের পিঠ ঠেকে গেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হিসেবে রাজনীতির স্বরূপ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে ছাত্র রাজনীতি কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ সাধনেই ব্যাপৃত; ছাত্র পরিচয় যেখানে অত্যাচারীর ভূমিকায় কদর্য-কুৎসিত মুখোশ ধারণ করে অবতীর্ণ, সেই ছাত্র রাজনীতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বৈচিত্র্যে ঠাসা উত্থান-পতনের বন্ধুর পথে হাঁটার সময় কত ঘটনাই দেখেছি! কিন্তু আজকের এই সময়ে এসে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের পারদকে ঊর্ধ্বগামী অনুভব করছি। আমাদের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরায়ত ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করে শিক্ষকদের যেভাবে বলীয়ান করেছে, তাতে আবার ভরসার সঞ্চার ঘটছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্বায়ত্তশাসনের প্রায়োগিক ব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হলগুলোকে সাধারণ ছাত্রদের জন্য অনুকূল হিসেবে ঢেলে সাজাতে হবে।
লেখক :
অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।