কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত লেখালেখির জীবন নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। বৈচিত্র্যে বর্ণাঢ্য নজরুল জীবনের একটা স্বচ্ছ ছবি বিপুল গবেষণাকর্ম থেকে উদ্ধার করা তবু সহজ নয়। নজরুলের সাহিত্য, দর্শন আর জীবন সম্পর্কে এত বেশি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে যে, পাঠককুল দিশাহারা হতে বাধ্য। বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নজরুলকে দিয়েছেন রহস্যাবরণ। নজরুল কখনো বিদ্রোহী, কখনো প্রেমিক, বিরহী, কখনো কালীর সাধক, কখনো ইসলামের তূর্য হাতে নব-নকীব; নজরুল সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের প্রেরণা, সবার উপরে নজরুল সর্বমানবিক এক স্বয়ম্ভূ বাঙালি কবি। বর্তমান রচনায় আমরা খুঁজে দেখতে চাইব বাঙালির প্রতিদিনের সংকটে-সংগ্রামে নজরুল কতটা প্রবল আর আবশ্যিক।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। নজরুলের জনপ্রিয়তা বিদগ্ধজনের মধ্যে জরিপের ফল নয়, বরং শিক্ষিত-অশিক্ষিত-জ্ঞানী-অর্ধজ্ঞানী, শিষ্ট-অশিষ্ট, শহুরে-গ্রাম্য, ইতর-ভদ্র সর্বস্তরে জরিপের ফল। শহুরে এলিট শ্রেণির বিচারে নজরুল হয়তো ততটা গ্রাহ্য নন, তবু বিশাল জনগোষ্ঠীর আবেগের মুখে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় তাকে অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা এলিট শ্রেণির সব সময় থাকে না।
ত্রিশোত্তর কাব্যধারায় আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাঙ্গণ কল্লোল ঘরানার দখলে ছিল। কল্লোল ঘরানার মেধাবী লেখক বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক কবিতা’ সংকলনে কাজী নজরুল ইসলামের কোনো কবিতা স্থান পায়নি; স্থান পেয়েছে কবির গান। নজরুলের সমকালে তাঁর কবিতা যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি তিনি সমালোচিত হয়েছেন নানাভাবে। স্বধর্মীয় মৌলবাদীরা কাফের ফতোয়া দিয়েছে- মুসলমান সমাজ থেকে তাকে খারিজ করতে চেয়েছে কেউ কেউ। মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন তো ১৯২৯ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে ‘লোকটা মানুষ না শয়তান’ শিরোনামে নেতিবাচক গদ্য লিখেছেন। সব বিরোধের মুখে ছাই চাপা দিয়ে নজরুল সাধারণ বাঙালির অন্তর ছুঁয়েছিলেন নিজের যোগ্যতায়। সবকিছুর পরও সাধারণের হৃদয় গভীরে কবি নজরুলের যে দীপ্ত অবস্থান তাকে টলানো যায়নি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মাঝে কবির এই বিপুল জনপ্রিয়তা কীভাবে দানা বাঁধলো! কীভাবে বাংলাদেশের মানুষ আর নজরুল একাকার হয়ে গেলেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে যখন দেখবো বাঙালির প্রাত্যহিক আনন্দ বেদনায় এবং নিত্যদিনের সংগ্রামে অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে মিশে আছেন তার গান ও কবিতা নিয়ে।
আধুনিক কবিতায় যে গভীর-জটিল অন্তর্জগৎ, নজরুলের কবিতায় তা প্রায় অনুপস্থিত। নজরুলের কবিতা স্বচ্ছ-মুক্ত-সহজ-সাহসী এবং ঋজু। নজরুলের কবিতা পড়ে সাধারণ পাঠককেও কোনো বোদ্ধা সমালোচকের শরণাপন্ন হতে হয় না। পাঠক নিজে নিজেই বুঝে নিতে পারেন কবি কী বলতে চান। সে অর্থে নজরুল সাধারণ মানুষের কবি। যখন আধুনিক কবিতার পাঠক হয়েছেন মুষ্টিমেয় এলিট শ্রেণি, তখন নজরুলের কবিতা হয়েছে সবার। নজরুলের কবিতায় সাধারণ মানুষের নানা প্রসঙ্গ উচ্চকিত হয়েছে অবলীলাক্রমে। ‘দেখিনু সেদিন রেলে কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে, চোখ ফেটে এলো জল, এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!’ সাধারণের ভাষা-সাধারণের জীবন বিধৃত হয়েছে নজরুল কাব্যে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ লোকবাংলার গ্রামীণ সমাজ, নজরুল কাব্যও সরাসরি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চেতনায় ঋদ্ধ। পূর্ব বক্তব্যের সমর্থনে নজরুল থেকে আগণন উদ্ধৃতি দেয়া যায়, নমুনা হিসেবে ক’টি পঙ্্ক্তি উদ্ধৃত করছি-
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা।- দিয়াছ তাপস,
অসংকোচ প্রকাশের দুরন্তসাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি; বাণী ক্ষুরধার,
বাণী মোর শাপে তব হলো তরবার।
স্কুল-কলেজে কখনো ছেলেমেয়েদের পাঠ্যসূচিতে আসেনি নজরুলের মানবিক উদ্দীপনার কবিতা। পাঠ্যসূচিতে এসেছে প্রভাতী চল্ চল্ চল্্, উমর ফারুক, খেয়াপারের তরণী, শাতিল আরব, মহররম, কোরবানি, কামালপাশা, মানুষ ইত্যাদি। লক্ষণীয় শাসক গোষ্ঠীর চাটুকারেরা বিভিন্ন কবিতায় প্রয়োজনীয় সংস্কার-পরিবর্তন করেছে ইচ্ছামতো। ধর্মান্ধ শ্রেণির বাঙলা ভাষা-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের বিপুল উপস্থিতির বিপক্ষে দাঁড় করানোর জন্য নজরুল প্রতিভাকে পুঁজি করা সহজ হয়েছিল। বিশেষত, তাদের জন্যে শাপে বর হয়েছিল নজরুলের বাক্্হীন নির্লিপ্ত বেঁচে থাকা। নজরুলের বাক্্হীন নির্লিপ্ত অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে নজরুল সাহিত্যে ইচ্ছামতো কাটাকাটি আর কলম চালিয়েছে স্বার্থান্ধ শ্রেণি, সুস্থ থাকলে যার প্রতিবাদ নজরুল নিশ্চয় করতেন। কাজী নজরুলের ইসলামি গানগুলোকে স্বার্থান্ধ শ্রেণি বিশেষভাবে ব্যবহার করেছে; কিন্তু সাধারণ মানুষ, ছাত্র-জনতা নিজেদের সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে নজরুলের সঠিক কবিতাটিই বেছে নিয়েছে, এবং সংগ্রামের উদ্দীপনা হিসেবে ব্যবহার করেছে বারবার।
নজরুল সাহিত্যে শ্যামা সংগীত, কীর্তন ও হিন্দু-পুরাণপ্রীতির পাশাপাশি মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিদ্রোহ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। একদিকে নজরুল লেখেন-
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি উপড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মুসলিম সমাজ যখন প্রাচীন ও মধ্যযুগের গৌরবদীপ্ত ভারতীয় সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে হিন্দু বলে, অন্যদিকে হিন্দুরাও ইসলামি ঐতিহ্য ও সাম্যের সংস্কৃতিকে মেøচ্ছ-যবন বলে ঘৃণা করেছে। নজরুল সেখানে বলেছেন, ‘মোর এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥’ একই সঙ্গে তিনি ভারতীয় ও ইসলামি ঐতিহ্যকে সফলভাবে উপস্থাপন করে হয়ে উঠেছেন সাধারণের নয়ন-মণি। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ইহুদি সব সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকে নজরুল পাশাপাশি উপস্থাপন করেছেন- কবিতাকে করেছেন সর্বজনীন। এমনি অগণন উদাহরণ পাই নজরুলের গান ও কবিতায়। আমাদের জীবদ্দশায়ই আমরা দেখেছি ’৬৯-এর গণআন্দোলনে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এবং ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কবি নজরুলের গানের ব্যবহার; প্রতিটি গান কীভাবে ছাত্র-জনতাকে উদ্দীপ্ত করেছে-
আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন;/ আমি স্রষ্টা সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বন্ধন করিব ভিন্ন!’ কিংবা ‘আসিতেছে শুভ দিন,/ দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!/ হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চলায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,/ পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,/ তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর মুটে ও কুলি,/ তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;/ তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,/ তাদেরই ব্যথিত বক্ষেক্ষ পা ফেলে আসে নব উত্থান !
উদ্দীপনার গান গেয়েছি আমরা-
মোরা ঝঞ্জার মতো উদ্দাম
মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল
মোর বিধাতার মতো নির্ভয়
মোর প্রকৃতির মতো স্বচ্ছ ॥
মোর আকাশের মতো বাধাহীন
মোরা মরুসঞ্চার বেদুঈন।
মোর বন্ধনহীন জন্ম-স্বাধীন/ চিত্তমুক্ত শতদল ॥
অথবা-
‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট’ ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/ এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।’ ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা/ জাগো সহা সীমন্তে রক্তটিকা॥/ দিকে দিকে ফেলি তব লেলিহান রসনা/ নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্বসনা,/ জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী/ বিশ্ব দাহন তেজে জাগো দাহিকা।’
’‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশিথে, যাত্রিরা হুঁশিয়ার।/ অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ,/কাণ্ডারী আজি দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ!/ হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?/ কাণ্ডারী বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র। ইত্যাদি।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’; ‘নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ/ জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত’ বাঙালির এই শাশ্বত চেতনা নজরুল সাহিত্যে উচ্চারিত হয়েছে বারবার। ‘গাহি সাম্যের গান-/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
এভাবেই নজরুল তার বিশ্বাস এবং সত্য উচ্চারণের শক্তি দিয়ে কবিতায়-গানে সাধারণ বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছিলেন বলেই তাত্ত্বিক-সমালোচকরা যেভাবেই তাঁকে ব্যাখ্যা করুন তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার ঘরের মানুষ, প্রাণের মানুষ। যে জাতি নজরুলের গান-কবিতায় উজ্জীবিত হয়ে সংগ্রাম করে এবং বিজয় অর্জন করে সে জাতি কি নজরুলকে অবজ্ঞা করতে পারে?
নিশ্চয়ই জাতি নজরুলের সর্বমানবিক চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে সমাজ থেকে অন্ধতা-বৈষম্য দূর করে প্রতিষ্ঠা করবে সাম্যের স্বদেশ। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার সংগ্রামেও নজরুল ছিলেন সমান উচ্চকিত। মানুষের চেতনায় প্রাসঙ্গিক।